নিজস্ব প্রতিনিধি, পুরুলিয়া: বাল্যবিবাহ রোধে লাগাতার প্রচার চালাচ্ছে সরকার। তবুও পুলিস-প্রশাসনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে প্রতি বছরই বিয়ে হচ্ছে হাজার হাজার নাবালিকার। বছর ঘোরার আগে অন্তঃসত্ত্বাও হয়ে পড়ছে তারা। গত এক বছরে পুরুলিয়া জেলায় নাবালিকা প্রসূতির সংখ্যা প্রায় আট হাজারেরও বেশি।
জেলা স্বাস্থ্য দপ্তর সূত্রের খবর, ২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত জেলায় মোট ৮ হাজার ৩৪৪ জন নাবালিকা অন্তঃসত্ত্বা হয়েছে। জেলায় প্রসূতি সংখ্যার নিরিখে নাবালিকা প্রসূতি ১৬ শতাংশ। অর্থাৎ, জেলায় ১০০ জন প্রসব করলে, তার মধ্যে গড়ে প্রায় ১৬ জনই নাবালিকা। যাদের বয়স ১৮-র কম। বেশ কিছু ব্লকে আবার এই পরিসংখ্যান আরও উদ্বেগজনক। যেমন, ঝলদা-২ ব্লকে নাবালিকা প্রসূতির হার ২৫ শতাংশ। বাঘমুণ্ডিতে ২১ শতাংশ, আড়শায় ২০ শতাংশ। জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক অশোক বিশ্বাস অবশ্য বলেন, ‘নাবালিকা প্রসূতির হার জেলার আরও বেশি ছিল। তবে আমরা এনিয়ে লাগাতার সচেতনতামূলক প্রচার করে যাচ্ছি। এতে ফলও পাচ্ছি। জেলায় নাবালিকা প্রসূতির হার আগের তুলনায় অনেকটাই কমেছে।’
জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, ২০২০-২১ সালে করোনার সময়ে পুরুলিয়া জেলায় নাবালিকা প্রসূতির সংখ্যা ছিল ১২ হাজার ৩০৬। সেবছর প্রতি ১০০ জন প্রসূতির মধ্যে ২২ জনই ছিল নাবালিকা। পরের বছর অর্থাৎ ২০২১-২২ সালে নাবালিকা প্রসূতির সংখ্যা বেড়ে হয় ১২হা জার ৮৭৪ জন। নাবালিকা প্রসূতির হার ছিল ২৩ শতাংশ। তারপর থেকে অবশ্য নাবালিকা প্রসূতির সংখ্যা কমতে শুরু করে জেলায়। ২০২২-২৩ সালে জেলায় মোট ন’হাজার ১৩৯ জন, ২০২৩-২৪ সালে ৮ হাজার ৩৪৪ জন নাবালিকা অন্তঃসত্ত্বা হয়েছে। চলতি বছরে আবার নাবালিকা প্রসূতির সংখ্যা ১৬ থেকে বেড়ে ১৮ শতাংশ হয়েছে। ১ এপ্রিল থেকে ১ আগস্ট পর্যন্ত মোট ৩ হাজার ১০৫ জন নাবালিকা অন্তঃসত্ত্বা হয়েছে।
স্বাস্থ্য কর্মীদের একাংশের মতে, বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে না পারলে নাবালিকা প্রসূতির সংখ্যা কোনওভাবেই কমানো যাবে না। প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কি প্রশাসনিক কোনও গাফিলতি হচ্ছে? কারণ, নাবালিকা বিয়ে বন্ধ করতে জেলার পুলিস-প্রশাসনের একাধিক কর্মসূচি রয়েছে। পুলিসের হতে রয়েছে কঠোর আইনও। রয়েছে কন্যাশ্রীর মতো মুখ্যমন্ত্রীর স্বপ্নের প্রকল্প। প্রতি স্কুলে রয়েছে কন্যাশ্রী ক্লাব। জেলা থেকে পঞ্চায়েতস্তর পর্যন্ত জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে আধিকারিকদের নিয়ে কমিটি রয়েছে। তার পরেও কেন বাল্যবিবাহ বন্ধে রাশ টানা যাচ্ছে না?
প্রশাসনের এক আধিকারিকের অবশ্য দাবি, বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে নাবালিকা বিয়ের কুফল প্রচার করা হচ্ছে। বাল্যবিবাহ রোধে কন্যাশ্রী-রূপশ্রীর মতো প্রকল্পের নিবিড় প্রচার চালানো হচ্ছে। জেলার কোন কোন এলাকায় এই প্রবণতা বেশি, তা চিহ্নিত করে পদক্ষেপ করা হচ্ছে। কোথাও বাল্য বিবাহের খবর পেলেই পদক্ষেপ করা হচ্ছে। যার ফলে আগের তুলনায় এই সংখ্যা কমছেও। অনেকে আবার বাল্যবিবাহের কারণ হিসেবে সমাজের মানসিকতাকেই দায়ী করছেন। গ্রামাঞ্চলে আজও মেয়েদের পরিবারের ‘বোঝা’ হিসাবে মনে করা হয়। পরিবারের লোকেরা বাড়ির মেয়ের বিয়ে দিতে পারলেই যেন বাঁচে!
জেলার শিশু সুরক্ষা দপ্তরের এক আধিকারিক বলেন, বাল্যবিবাহ নিয়ে প্রতি স্কুলে স্কুলে আমরা সচেতনতামূলক প্রচার কর্মসূচি চালু করতে চলেছি। চাইল্ড লাইনের ১০৯৮ হেল্পলাইন নম্বর রয়েছে। কোথাও কোনও বাল্যবিবাহের খবর থাকলে বাসিন্দারা তা জানাতে পারেন। পরিচয় সম্পূর্ণ গোপন থাকবে। আমরা নাবালিকার বিবাহ রোধে সবরকম পদক্ষেপ করব।