সুমিত বিশ্বাস ও অমিতলাল সিং দেও, পুরুলিয়া ও মানবাজার: তখন সন্ধ্যা ৬ টা ৪৮। পুজোর প্রাক্কালে গমগম করছে শহর পুরুলিয়ার সিটি সেন্টার-দেশবন্ধু রোড এলাকা। আচমকা দ্রুত গতিতে একটি সোনার দোকানের কাছে এসে দাঁড়াল পুলিশের গাড়ি। তার পিছনে হাজির আরও কিছু গাড়ি। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই কালো রঙের গাড়ি থেকে ঘরোয়া পোষাকে লাফিয়ে বেরিয়ে এলেন পুরুলিয়া জেলা পুলিশ সুপার অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায়। ট্রিগারে হাত রেখে চোখ তখন ডাকাতের খোঁজ করছে। নিজেকে গার্ড করে পজিশন নিয়ে ঢুকে পড়লেন সোনার দোকানে। তাঁর পিছনে পিস্তল হাতে দেহরক্ষীও। এমন পরিস্থিতি দেখে হতভম্ভ হয়ে পড়েন ওই শোরুমে থাকা সকলে। কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে পৌঁছে যান আরও পুলিশ আধিকারিকরা।
কিন্তু হয়েছে টা কী? কিছুক্ষণ পর পরিস্থিতি আঁচ করে ওই দোকানের কর্মীদেরকে প্রশ্ন পুলিশ সুপারের, ‘সব ঠিকঠাক আছে তো?’ ঘটনার আকস্মিকতায় সকলে তখন ‘থ’। বেশ কিছুক্ষণ পরে ঘাড় নেড়ে এক কর্মী জানালেন, ‘হ্যাঁ’। কিন্তু কি এমন ঘটল যে পায়ে স্যান্ডেল, ঘরোয়া পোশাকে এহেন যুদ্ধই দেহী মুডে খোদ পুলিশকর্তা! আসলে সন্ধে নামার কিছু আগেই জেলা পুলিশ কার্যালয় থেকে ফিরে উর্দি খুলে ঘরোয়া পোষাকে চা নিয়ে বসেছিলেন পুলিশ সুপার। তখন পুরুলিয়া জেলা আদালতে ছিলেন পুরুলিয়া সদর থানার আইসি শিবনাথ পাল। হঠাৎ তাঁর ফোনে বিপদবার্তা বা ‘এসওএস’ বেজে ওঠে। মোবাইল হাতে নিয়েই তিনি দেখেন ডিসপ্লেতে ভাসছে কল্যাণ জুয়েলার্সের ‘ডেঞ্জার বটন’। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ফোন করেন পুলিশ সুপারকে। ” স্যার, কল্যাণ শোরুমে ডাকাতি।”
এইটুকু বলতেই ফোন রেখে তড়িঘড়ি নিজের গাড়িতে একজন দেহরক্ষীকে নিয়ে উঠে পড়েন পুলিশ সুপার। পেছনে তাঁর নিরাপত্তা বলয়। তিন মিনিটের কম সময়ে বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে ৯ এম এম গ্লক পিস্তল হাতে ঘটনাস্থলে পৌঁছান এসপি। তারপরেই অতিরিক্ত ডিএসপি (শৃঙ্খলা ও প্রশিক্ষণ), আইসি অন্যান্য পুলিশ আধিকারিক, অতিরিক্ত বাহিনী সেখানে পৌঁছয়। পরে জানা যায়, ভুল করে হাত লেগে ‘সুরক্ষা’ প্যানিক বোতামে টিপে ফেলেছিলেন ওই সোনার দোকানের এক কর্মী।
২০২৩ সালের ২৯ আগস্ট পুরুলিয়া শহরের নামোপাড়ায় দিনে দুপুরে সেনকো গোল্ডের শোরুমে ডাকাতি হয়। ওই ঘটনার পরেই স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তার জন্য ‘সুরক্ষা’ নামে একটি বিশেষ অ্যাপ চালু করে পুরুলিয়া জেলা পুলিশ। জেলা পুলিশের এক আধিকারিকের কথায়, বিভিন্ন স্বর্ণ বিপণি কেন্দ্রে সিমকার্ড যুক্ত একটি ডিভাইস লাগানো রয়েছে। তাতে পুরুলিয়া সদর থানার আইসি, জেলা পুলিশের কন্ট্রোল রুম সহ পাঁচটি ফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে। শো- রুমের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি জায়গায় লাগানো রয়েছে ছোট সেই প্যানিক বোতাম। আচমকা যদি কোনো ডাকাত দল হানা দেয় তাহলে ওই বোতাম চাপ দিলে ফোন যাবে পুলিশের কাছে। ভুলবশত সেটাই ঘটে এখানে।
কিন্তু এদিন জেলা পুলিশের তৎপরতা দেখে বাহবা জানিয়েছেন ওই স্বর্ণ বিপণি কেন্দ্রের কর্মকর্তা থেকে আম জনতা। পুলিশ সুপার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “সন্ধেবেলায় হঠাৎ করে পুরুলিয়া টাউন আইসির ফোন পাই। তিনি জানান, বোধহয় কল্যাণ জুয়েলার্সে কোন কিছু দুর্ঘটনা ঘটেছে। আমি সেখানে তৎক্ষণাৎ গিয়ে জানতে পারি বিপনীর কোন এক কর্মী ভুল করে এসওএস বোতামে চাপ দিয়ে ফেলেন।” ওই জুয়েলার্সের কর্মী তরুণ সেন বলেন, “ভুল করে ওই প্যানিক বোতাম টিপে ফেলেছিলাম। তবে পুলিশ যেভাবে এমনকি এসপি তিন মিনিটের কম সময়ে আমাদের বিপনিতে হাজির হলেন তাতে আমরা হতবাক। আক্ষরিক অর্থেই পুরুলিয়া পুলিশ তৎপর। এটা যেন আরও একবার প্রমাণ হয়ে গেল।”