‘তদন্তে এসওপি মানেনি কলকাতা পুলিশ’, দাবি নির্ভয়া মামলার তদন্তকারীর
এই সময় | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪
নির্ভয়া মামলায় দাঁতের কামড়ের দাগ থেকে বেশ কিছু সূত্র পাওয়া গিয়েছিল। এই ধরনের মামলায় নখের আঁচড় এবং দাঁতের কামড়ের দাগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বৃহস্পতিবার দিল্লি থেকে ফোনে কথা বলছিলেন নির্ভয়া মামলার তদন্তকারী অফিসার রাজেন্দ্র সিং। তাঁর দাবি, ‘আরজি করের ঘটনার ক্ষেত্রে মিডিয়াতে যা বলা হচ্ছে এবং পরবর্তীকালে পুলিশ কর্তারা যে পাল্টা যুক্তি দিচ্ছেন, তার ভিত্তিতে বলতে পারি, বেশ কিছু তথ্য এর ফলে লোপাট হয়েও থাকতে পারে।’তাঁর স্পষ্ট অভিযোগ, এই ঘটনায় যে এসওপি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর) মেনে কলকাতা পুলিশের তদন্ত শুরু করা উচিত ছিল, তা মানা হয়নি। নির্ভয়ার ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা দেশকে। বস্তুত, সেই প্রথম সারা দেশ জুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ২০১২-র ডিসেম্বরে এক শীতের রাতে ওই ঘটনার পরে প্রতিবাদের চাপে দেশের আইন বদলাতে বাধ্য হয় কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার।
যদিও গত ৯ অগস্ট আরজি করের তরুণী চিকিৎসকের ক্ষেত্রে প্রতিবাদের যে ঝড় উঠেছে, তা এককথায় নজিরবিহীন বলে দাবি করেছেন সকলেই। দু’টি ক্ষেত্রেই অপরাধের ধরণ এক। নির্ভয়া কাণ্ডের তদন্তে অভিজ্ঞ অফিসার, দিল্লি পুলিশের এসিপি পদ থেকে কিছুদিন আগে অবসর নেওয়া রাজেন্দ্র বৃহস্পতিবার ‘এই সময়’কে বলেন, ‘সিন অফ ক্রাইমে অত লোককে ঢুকতে দেওয়া পুলিশের চরম ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। ওখানে পুলিশ অফিসার এবং প্রত্যক্ষদর্শী ছাড়া আর কারও থাকার কথাই নয়। এতে বায়োলজিক্যাল এভিডেন্স নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।’
কী করা উচিত? রাজেন্দ্রর বক্তব্য, ‘এমন ঘটনায় শুধুমাত্র ক্রাইম সিনের জন্য একজন স্পট অফিসার রাখার কথা। খবর পেয়ে যাঁরা ওখানে জড়ো হবেন, তাঁরা যাতে ঘরের বাইরে থাকেন সে বিষয়ে স্পট অফিসারের কড়া হওয়া উচিত ছিল। মাথায় রাখতে হবে ধর্ষণ এবং খুনের তদন্তে ভিক্টিম, অ্যাকিউজ়ড এবং ক্রাইম সিন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ।’
নির্ভয়া কাণ্ড ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি স্পর্শকাতর মামলার দায়িত্বে ছিলেন দিল্লি পুলিশের এই অফিসার। এভিডেন্স কালেকশন এবং ফরেন্সিকের বিষয়ে তাঁর দক্ষতা রয়েছে। ‘আপনি এই মামলার ক্ষেত্রে কী করতেন?’ রাজেন্দ্রর ব্যাখ্যা, ‘তরুণী চিকিৎসকের দেহ যথাযথ ভাবে সংরক্ষণ করতাম। যে অভিযুক্ত তাকেও সাবধানে হ্যান্ডেল করতে হতো। কারণ, সে আগেই নিজের চেহারা থেকে বেশ কিছু প্রমাণ নষ্ট করার মতো সময় পেয়ে গিয়েছে। একই সঙ্গে যে সব জিনিস ঘটনাস্থল থেকে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে তা সাবধানে রাখার চেষ্টা করতাম। অনেক সময়ে নির্যাতিতারা বেঁচে থাকলেও মেডিক্যাল করাতে চান না। কলকাতায় তা হয়নি। কারণ, তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। ফলে আরজি করের মৃত চিকিৎসকের দেহ থেকে বায়োলজিক্যাল এভিডেন্স সব কালেক্ট করা হয়েছিল কি না, তাও স্পষ্ট নয়।’
রাজেন্দ্র জানাচ্ছেন, যে কোনও ধর্ষণের মামলায় পেনিট্রেশন, ম্যানিপুলেশন, ইনসারশন এবং মাউথ অ্যাপ্লিকেশন দেখা ভীষণ ভাবে জরুরি। আবার ক্রাইমের সময়ে পেনিট্রেশনের ক্ষেত্রে অভিযুক্তের হাত এবং পা ব্যবহার করা হয়। ফলে সে সব জায়গা থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করা যায়। এতে বোঝা যায়, কী ভাবে বা কতটা নৃশংস ভাবে ধর্ষণ করা হয়েছে।
তবে, তদন্তে তাড়াহুড়ো করা ঠিক নয়। সবকিছু বেশ সময়সাপেক্ষ। এই কাজের জন্য ময়নাতদন্ত করেন যে চিকিৎসক, তাঁর ভূমিকা সবচেয়ে ভাইটাল বলেও রাজেন্দ্রর দাবি। তাঁর কথায়, ‘আরও একটা কথা বলতে চাই, যে কোনও ধর্ষণ এবং খুনের তদন্তে ক্রাইম সিন ইনট্যাক্ট রাখা যে কোনও তদন্তকারী সংস্থার প্রধান কাজ। যদি ওটা ঠিক থাকে তবে এভিডেন্স দিয়ে অপরাধ প্রমাণ করাটা সহজ হয়ে যায়।
নির্ভয়ার ঘটনায় এই কাজটা আমরা ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টার মধ্যে সেরে ফেলেছিলাম। ফলে অভিযুক্তদের দোষী প্রমাণ করতে বেগ পেতে হয়নি। মিডিয়া যখন বিষয়টি নিয়ে হৈচৈ শুরু করেছিল, তার আগেই আমাদের তদন্তের কাজ প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। আদালতে সে সব নথিও জমা দেওয়া হয়েছিল।’
নির্ভয়ার ঘটনার সঙ্গে আরজি করের ঘটনার তুলনা টেনে তিনি বলেন, ‘এটাও মাথায় রাখবেন, কলকাতার ঘটনাটা ঘটেছিল একটা ঘরের ভিতরে। কিন্তু দিল্লির ঘটনাটা ছিল রাস্তায়, চলন্ত বাসে। ফলে সেখানে এডিডেন্স নষ্ট হওয়ার সবচেয়ে বেশি সম্ভবনা ছিল। আমরা কিন্তু তা হতে দিইনি।’
‘আপনার কী মনে হয় হাসপাতালের তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে কলকাতা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ করা উচিত ছিল?’ প্রাক্তন পুলিশ কর্তার জবাব, ‘অবশ্যই উচিত ছিল। বহু ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রাতিষ্ঠানিক কোনও বিষয় থেকে এরকম ক্রাইম হতে পারে। আরজি করেও যে হয়নি, তা কে বলতে পারে?’