অন্তঃসত্ত্বা হাতির পিঠে শলাকা ছুড়ল কে? কেউ নাকি দেখেনি
এই সময় | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪
নৃশংসতার নিরিখে মিলে গিয়েছে আরজি কর আর ঝাড়গ্রাম। তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ-খুনের ঘটনার মতো অন্তঃসত্ত্বা হাতিকে জ্বলন্ত শলাকা মেরে খুনের ঘটনায় বিক্ষোভ নেমেছে রাস্তায়।অভিযোগ, ১৫ অগস্ট বিকেলে ঝাড়গ্রামের ডিএম অফিসের সামনে পাঁচিল ঘেরা ঝোপ-জঙ্গলে ঢুকে পড়া মাদি হাতির পথ আটকে একটি পরিত্যক্ত বাড়ির ওপর থেকে প্রায় ৬ ফুটের লোহার জ্বলন্ত শলাকা ছোড়া হয় তার পিঠে। যন্ত্রণায় চিৎকার করতে থাকে হাতিটি। পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পরদিন সকালেই মারা যায় সে। তার পরে উঠেছে হাতি তাড়াতে হুলাপার্টির বেআইনি ব্যবহার নিয়ে। নিশানায় বন দপ্তরের গাফিলতিও। হুলাপার্টির দু’জনকে গ্রেপ্তারিতেও কমেনি ক্ষোভ। বরং হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলায় উঠে এসেছে ‘প্রকৃত অপরাধী’র প্রসঙ্গ।
কে বা কারা প্রকৃত অপরাধী? কেন জ্বলন্ত শলাকা বিঁধে কার্যত দগ্ধে মরতে হলো অন্তঃসত্ত্বা হাতিটিকে? প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ২৩ অগস্ট বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গড়েন রাজ্যের হেড অফ ফরেস্ট নীরজ সিঙ্ঘল। সম্প্রতি সেই কমিটির অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণের রিপোর্ট জমা পড়েছে বন দপ্তরে। আর সেখানেও অন্তঃসত্ত্বা হাতির খুন নিয়ে উঠে এসেছে অজস্র প্রশ্ন।
অভিযোগ, হাতি তাড়াতে যাওয়ার সময়ে এবং তার পরবর্তী ঘটনাক্রমের বহু ক্ষেত্রেই এসওপি বা স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর মানা হয়নি। বিশেষজ্ঞ কমিটি তার অনুসন্ধানে জানিয়েছে, জ্বলন্ত লোহার শলাকা (হুলা) গেঁথেই যে হাতিটির শরীরে গভীর ক্ষত হয়েছিল, সেটা ময়নাতদন্তের রিপোর্টে স্পষ্ট। প্রায় ৮-৯ ইঞ্চি গভীরে গেঁথে সেটি হাতির শরীর ঝলসে দিয়েছিল।
সূত্রের দাবি, অথচ হাতি-মৃত্যুর ঘটনার প্রাথমিক সরকারি রিপোর্টে হুলার উল্লেখই নেই। ১৫ অগস্ট বন দপ্তরের তিনটি রেঞ্জ থেকে তিনটি হুলাপার্টি ডেকে আনা হয়েছিল, যাদের মিলিত সদস্য প্রায় ৭০-৮০। অথচ সে দিন ঘটনাস্থলে উপস্থিত হুলাপার্টি এবং বন দপ্তরের কর্মীরা বিশেষজ্ঞ কমিটিকে জানিয়েছেন, তাঁদের কেউই নাকি ঘটনাটি ঘটতে দেখেননি! প্রশ্ন, তা হলে কাদের তথ্যের ভিত্তিতে হুলাপার্টির অজয় ও দীপক মাহাতকে ২২ অগস্ট হাতি-হত্যায় গ্রেপ্তার করা হলো?
পশ্চিমবঙ্গেরই একটি মামলায় ২০১৮-তে সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল, হাতিকে তাড়াতে হুলার ব্যবহার করা যাবে না। ঝাড়গ্রামে ধৃত দুই হুলা সদস্যের পরিবার জানাচ্ছে, ১৫ অগস্ট সকালে স্থানীয় বনকর্মীরাই হাতি তাড়াতে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁদের। কেন সুপ্রিম কোর্টের নিষেধাজ্ঞার পরেও সরকারের তরফে হাতি নিয়ন্ত্রণে হুলা পার্টির ব্যবহার হচ্ছে, তার সদুত্তর নেই।
বিশেষজ্ঞ কমিটি জানিয়েছে, বনকর্মীদের যে দলটি সে দিন ঝাড়গ্রামে হাতি তাড়াচ্ছিল, তারা ১৩ অগস্ট থেকে টানা ডিউটিতে ছিল। প্রবল ক্লান্তি শরীরে জেঁকে বসেছিল। ১৫ অগস্ট সকালে এক ব্যক্তিকে পিষে দেওয়ার পরে একটি হাতিকে ঘুমপাড়ানি গুলিতে কাবু করতে ব্যস্ত থাকায় হাতি-হত্যার ঘটনাস্থলে ডিএফও ছিলেন না। প্রবল ভিড়ে ক্রাউড ম্যানেজমেন্টও কার্যত ফেল করেছিল। চারদিক থেকে স্থানীয়রা ঘিরে ফেলায় হাতির দল পালানোর পথ পায়নি।
এখানেই বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্যদের প্রশ্ন, ক্লান্ত বনকর্মীদের সরিয়ে অন্যদের হাতি উদ্ধার বা হাতি খেদানোর কাজে নামানো হয়নি কেন? হাতি তাড়ানোর পরিস্থিতি তৈরি হলে সেই এলাকায় ১৬৩ ধারা (সাবেক আইপিসি ১৪৪) কার্যকর করার কথা পুলিশের। তাদের কি বন দপ্তর যথাসময়ে খবর দিয়েছিল? দেওয়া হলে স্থানীয়দের ভিড় কেন নিয়ন্ত্রণ করা গেল না? সূত্রের দাবি, হুলাপার্টির সদস্যদের গাইড করতে কোনও অভিজ্ঞ বনকর্মী ছিলেন না।
বিশেষজ্ঞ কমিটির চার সদস্য— পিসিসিএফ সন্দীপ সুন্দ্রিয়াল, আইএফএস এনএস মুরলী, আইএফএস বিদ্যুৎ সরকার এবং রাজ্য ওয়াইল্ডলাইফ বোর্ডের মেম্বার জয়দীপ কুণ্ডু তাঁদের বক্তব্য জমা করেছেন বন দপ্তরের কাছে। রাজ্যের শীর্ষ বনাধিকারিকরা গোটা ঘটনার জন্য ‘অ্যাবসেন্স অফ অ্যাকটিভ অ্যান্ড এফেক্টিভ ক্রাউড ম্যানেজমেন্ট’-কেই মূলত দায়ী করছেন। তাঁদের দাবি, পরিস্থিতির চাপেই এই ‘অ্যাক্সিডেন্ট’। প্রশ্ন উঠেছে, হাতি-হত্যা এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতা বন দপ্তরের স্থানীয় আধিকারিকরা কি এড়াতে পারেন?
নীরজ সিঙ্ঘলের কথায়, ‘আমাদের কাছে এখনও কারও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ আসেনি। হাইকোর্টের বিচারপতিও তাঁর শুনানিতে আমাদের এমন কোনও নির্দেশ দেননি।’