• আরজি করের তদন্ত পুরো এসওপি মেনেই, দাবি লালবাজারের
    এই সময় | ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • এই সময়: আরজি কর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ এবং খুনের তদন্ত যাবতীয় আইনি প্রক্রিয়া মেনেই হয়েছিল বলে দাবি করল লালবাজার। ওই ঘটনায় তদন্তের পদ্ধতি নিয়ে বৃহস্পতিবার কলকাতা পুলিশকে কার্যত কাঠগড়ায় তুলেছিলেন নির্ভয়া মামলার তদন্তকারী অফিসার, দিল্লি পুলিশের প্রাক্তন এসিপি রাজেন্দ্র সিং।কিন্তু শুক্রবার লালবাজারের পাল্টা দাবি, এমন কোনও কাজ তারা করেনি যাতে সেমিনার রুমের এভিডেন্স নষ্ট হতে পারে। রাজেন্দ্রর অভিযোগ উড়িয়ে কলকাতা পুলিশের বক্তব্য, যাবতীয় তদন্ত এসওপি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর) মেনেই হয়েছিল। এমনকী, দেহ ময়নাতদন্তের জন্য এনআরএস হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হলেও বিক্ষোভকারীদের বাধায় তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

    কলকাতা পুলিশের ব্যাখ্যা, তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করার পরে আরজি করের তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে জিজ্ঞাসাবাদের প্রক্রিয়া শুরু হতে না হতেই মামলা সিবিআইয়ের হাতে চলে যাওয়ায় প্রাথমিক কিছু বিষয় ছাড়া তাঁর কাছ থেকে আর কিছু জানা সম্ভব হয়নি।

    কী হয়েছিল সেমিনার রুমে?

    সূত্রের খবর, খুনের ঘটনা জানাজানি হওয়ার পরে যে পুলিশকর্মী খবর পেয়ে প্রথম অকুস্থলে(সেমিনার রুম) পৌঁছন, তিনি দেখতে পান, কয়েকজন চিকিৎসক ওই ঘরের বাইরে সেই সময়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। কর্তব্যরত পুলিশকর্মী প্রথমেই বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেন। সেখানে দাঁড়িয়ে টালা থানার ওসিকে ফোন করেন তিনি। থানা থেকে বিরাট পুলিশ বাহিনী হাসপাতালে আসার পরে একটি দল সেমিনার রুমের ভিতরে ঢুকে কাজ শুরু করে।

    প্রথমেই ক্রাইম সিন দু’টি ভাগে কর্ডন করে দেওয়া হয়। হাসপাতালের চাদর দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয় ডিয়াসের একাংশ এবং দরজার সামনের দিক। সে সময়ে দরজা বন্ধ থাকায় অন্য দলের বাকি পুলিশকর্মীরা বাইরে অপেক্ষা করতে থাকেন। এরই মধ্যে খবর পেয়ে একঝাঁক চিকিৎসক-পড়ুয়া সেখানে হাজির হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। তবে তাঁদের কাউকেই সেমিনার রুমের ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।

    পুলিশের দাবি, ঘটনাস্থল থেকে তরুণী চিকিৎসকের দেহ সেই সময়ে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু পড়ুয়াদের বিক্ষোভের মুখে তা-ও সম্ভব হয়নি। ফলে ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল অফিসার নিজেই সেমিনার রুমে হাজির হন। সেখানেই পরীক্ষার পরে নির্যাতিতাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন তিনি। এরপর হাসপাতালে উপস্থিত তরুণী চিকিৎসকের বাবা-মাকে সেমিনার হলের ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হয়।

    এমনকী, তাঁরা অনুরোধ করায় তাঁদের এক আত্মীয়কেও ভিতরে যেতে দেয় পুলিশ। দেহ দেখার পরে বাড়ির লোকেদের সেখানে বসার জন্য চেয়ারের ব্যবস্থা করেন তদন্তকারীরা। পুলিশের দাবি, বাইরে অপেক্ষা করতে থাকা বিক্ষোভরত পড়ুয়ারা ততক্ষণে দু’টি দলে ভাগ হয়ে গিয়েছেন। একদলের দাবি, ময়নাতদন্ত এনআরএসে করাতে হবে, অন্যদলের বক্তব্য, আরজি করেই হবে পোস্ট মর্টেম।

    লালবাজার আরও দাবি করেছে, করিডরে উপস্থিত চিকিৎসকদের মতপার্থক্য ওখানেই শেষ হয়নি। দুই দল আরও একটি সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে আড়াআড়ি ভাগ হয়ে যান। ময়নাতদন্তের সময়ে সেখানে কারা উপস্থিত থাকবেন, কোন চিকিৎসকেরা সেই কাজ করবেন, তা নিয়েও তাঁদের নিজেদের মধ্যে দেখা দেয় সমস্যা। এরপর পড়ুয়ারা মৃতার বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলার পরে হাসপাতালের সুপারকে একটি দাবিপত্র জমা দেন।

    সুপার তা গ্রহণও করেন। সেই সময়ে ভিড় বাড়তে থাকে সেমিনার রুমের সামনে। ঘরের ভিতরে কেউ যেন ঢুকে না পড়েন সেজন্য সেমিনার রুমের দরজার কাছে একটি দশ ফুটের জায়গা ছেড়ে দেওয়া হয়। সেখানেই আলোচনার জন্য জমায়েত হন চিকিৎসকেরা। তবে কথা শেষ হলেই তাঁদের সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া শুরু করেন পুলিশকর্মীরা।

    ততক্ষণে সেমিনার রুমের ভিতরে একজন ফটোগ্রাফার, ভিডিয়োগ্রাফার, ফিঙ্গার এবং ফুটপ্রিন্ট বিশেষজ্ঞ, টালা থানার অফিসার, সিটের সদস্য, ফরেন্সিক টিম এবং সিনিয়র অফিসারেরা তদন্তের কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। এঁদের প্রত্যেকেই ৫০ ফুট ঘরের মধ্যে ৪০ ফুট অংশে ঢোকার অনুমতি পেলেও বেশিক্ষণ সেখানে দাঁড়ানোর সুযোগ পাচ্ছিলেন না।

    পুলিশের দাবি, দেহ ইনকোয়েস্ট করার সময়ে সেখানেও একজন ম্যাজিস্ট্রেট, দু’জন মহিলা সাক্ষী, বাবা-মা, ফরেন্সিকের অফিসাররা ছাড়াও ভিডিয়োগ্রাফার ছিলেন। আর অকুস্থল থেকে নমুনা সংগ্রহের সময়েও হাজির ছিলেন সিজ়ার উইটনেস, তদন্তকারী অফিসার এবং ভিডিয়োগ্রাফার। আর কাউকে সেখানে থাকতে দেওয়া হয়নি। সব কাজ শেষ হওয়ার পরে হাসপাতালের দু’জন স্টাফ দেহ নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি ট্রলি নিয়ে আসেন।

    ওই সময়ে বিক্ষোভকারীরা ফের নানা রকম দাবি জানাতে থাকেন। তবে ওই উত্তেজনার সময়েও তাঁদের ১০ ফুট ঘেরা জায়গার মধ্যে আটকে রাখা হয়েছিল, কাউকে ঘটনাস্থলে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।

    কেন সন্দীপকে জিজ্ঞাসাবাদ নয়?

    লালবাজারের দাবি, ঘটনার পর থেকে বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য সন্দীপের সঙ্গে কথা বলা শুরু করেন তদন্তকারীরা। কার কাছ থেকে এই ঘটনার বিষয়ে প্রথম জানতে পারলেন, সিসিটিভিগুলি ঠিক কোথায় লাগানো রয়েছে, সেমিনার রুম দেখভালের দায়িত্ব কার ছিল, ডিউটি রস্টার কী ভাবে রাখা হতো, তদন্ত সংক্রান্ত এমন ধরনের প্রাথমিক প্রশ্নের মুখে পড়েন সন্দীপ।

    কলকাতা পুলিশের এক কর্তার বক্তব্য, ‘মাত্র ৪ দিনের জন্য এই ঘটনার তদন্ত করার সুযোগ পেয়েছিলাম আমরা। ফলে আমাদের কাছে প্রায়োরিটি ছিল, নথি সংগ্রহ করার পাশাপাশি মূল অপরাধী কে, তা খুঁজে বের করা। তাই সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখা, রাতে ডিউটিতে থাকা সব কর্মীর সঙ্গে কথা বলে সিচুয়েশন বোঝার চেষ্টা করছিলাম আমরা।’

    তাঁর দাবি, এরপরেই চেস্ট মেডিসিনের বিভাগীয় প্রধান, হাসপাতালের সহকারী অধ্যক্ষ এবং সন্দীপ ঘোষকে খুনের কারণ সংক্রান্ত বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। ফলে তিনি যে পুলিশের নজরের বাইরে ছিলেন, সেই তথ্য ঠিক নয়।

    তড়িঘড়ি সৎকার কেন?

    কলকাতা পুলিশের দাবি, ময়নাতদন্তের পরে হাসপাতালের মর্গেই অভিভাবকদের হাতে দেহ তুলে দেওয়া হয়। পরিবারের অনুরোধে চিকিৎসকের দেহ এসকর্ট করে সোদপুরের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেয় পুলিশ। তদন্তকারীদের প্রশ্ন, যদি পরিবারের লোকেরা বলতেন দেহ সংরক্ষণ করবেন, তাহলে পড়ুয়ারা ময়নাতদন্তের পরে দেহ কি মর্গ থেকে বের করতে দিতেন?

    অন্যদিকে, পরিবারের লোকেরা অনুমতি না দিলে সেই দেহ কি সৎকার করা সম্ভব? যেখানে একাধিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি উপস্থিত রয়েছেন, হাজির হয়েছেন অন্যান্য আত্মীয়রাও। পুলিশের দাবি, শ্মশানের ফুটেজ দেখলেও বোঝা যাচ্ছে, সেখানে পরিবারের লোকেরাই শুধুমাত্র উপস্থিত রয়েছেন। পুলিশ সেখানে শুধু ভিড় সামলানোর কাজ করছে।

    একই সঙ্গে নিজেদের পক্ষে আরও একটি যুক্তি দিচ্ছেন লালবাজারের পুলিশ কর্তারা। তা হলো, হাসপাতাল থেকে দেহ বের করার সময় সেদিন মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সিপিএমের নেতা-কর্মীরা বাধা দিচ্ছিলেন। ওই অবস্থায় পরিবারের পক্ষ থেকে সম্মতি না দিলে বাড়িতে দেহ নিয়ে যাওয়া পুলিশের পক্ষে আদৌ কি সম্ভব?
  • Link to this news (এই সময়)