আরজি করের ঘটনার পর রাজ্যের বিভিন্ন সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ‘প্রভাবশালী’ চিকিৎসকদের একাংশের মৌরসি পাট্টা ভাঙতে উদ্যোগী হয়েছে রাজ্য প্রশাসন। ওই সব জায়গায় যাঁরা নাগাড়ে বহু বছর থাকার ফলে প্রভাব বিস্তার করে কার্যত ছড়ি ঘুরিয়ে আসছেন, এ বার তাঁদের ডানা ছাঁটার কাজ শুরু করে দিল প্রশাসন। এ রকম মোট ২৫ জন সিনিয়র রেসিডেন্ট ডক্টরকে প্রাথমিক ভাবে চিহ্নিত করেছে ডিরেক্টর অফ হেল্থ সার্ভিসেস অ্যান্ড মেডিক্যাল এডুকেশন।ওই রেসিডেন্ট ডক্টররা মেডিক্যাল কলেজ থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি বা ডিপ্লোমা করার পরেও প্রভাব খাটিয়ে সেখানে থেকে গিয়েছেন। স্বাস্থ্য দপ্তর সূত্রের খবর, ওই ২৫ জনের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। প্রশাসন সূত্রের খবর, বন্ডের শর্ত হিসেবে মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করার পরে জেলা বা মহকুমা স্তরের অন্য সরকারি হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তিন বছর সার্ভিস দেওয়ার কথা থাকলেও তাঁরা সেই নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছেন, এমনটা অভিযোগ।
এমনকী, বন্ডের মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়ার পরেও তাঁরা মেডিক্যাল কলেজ থেকে নিয়মিত বেতন তুলেছেন! এ সব ‘প্রভাবশালী’ সিনিয়র রেসিডেন্ট ডাক্তারকে অবিলম্বে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলো থেকে অন্যত্র সরানোর পাশাপাশি কারা এই বেআইনি কাজ বা অনিয়মে অনুমোদন বা মদত দিয়েছেন, তাঁদের খুঁজে বার করতে রাজ্যের প্রথম সারির পাঁচটি মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপ্যাল এবং ডিরেক্টরদের চিঠি দিয়েছেন স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা কৌস্তভ নায়েক।
ওই তালিকায় রয়েছে এসএসকেএম, বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, মালদা মেডিক্যাল কলেজ এবং নর্থ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ। ডিরেক্টরেট অফ মেডিক্যাল এডুকেশনের তরফে রাজ্যের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপ্যালদের কাছে যে নির্দেশিকা পাঠানো হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে রেডিয়োথেরাপি-তে এমডি করার পর এক সিনিয়র রেসিডেন্ট ডাক্তারকে বন্ড পিরিয়ডে গঙ্গারামপুর মহকুমা হাসপাতালে যোগ দিতে বলা হয়েছিল।
কিন্তু তিনি সেখানে না-গিয়ে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজেই দিব্যি থেকে গিয়েছেন। তেমনই বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ থেকে মাইক্রোবায়োলজি-তে এমডি করার পর এক জনের কালিম্পং জেলা হাসপাতালে যোগ দেওয়ার কথা থাকলেও তিনি সেখানে যাননি। সেই চিকিৎসক বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজেই থেকে গিয়েছেন এবং নিয়মিত মাইনে পেয়েছেন। একই ভাবে নর্থ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ থেকে প্যাথলজি-তে এমডি এক জনকে কালিম্পং জেলা হাসপাতালে পাঠানোর নির্দেশ জারি হলেও তিনি শেষমেশ প্রভাব খাটিয়ে নর্থ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজেই থেকে যান।
এমন অনিয়মের পরেও তাঁরা বন্ড কমপ্লিশান সার্টিফিকেটের জন্য আবেদন করেছেন। কেউ কেউ আবার পিজিটি হিসেবে আবেদন করেছেন তাঁদের সময়সীমা বাড়ানোর। অভিযোগ উঠছে, মেডিক্যাল কলেজে মৌরসি পাট্টা চালিয়ে যেতেই তাঁরা সেখানে আরও বেশি দিন থাকতে চাইছেন। তবে আরজি করের ঘটনার প্রেক্ষিতে এ বার সেই ঘুঘুর বাসা ভাঙতে সরকার পদক্ষেপ করছে।
ডিরেক্টর অফ হেল্থ সার্ভিসেস অ্যান্ড মেডিক্যাল এডুকেশন-এর এক শীর্ষকর্তার ব্যাখ্যা, মেডিক্যাল কলেজে যে কোনও পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি বা ডিপ্লোমা কোর্স করতে গেলে প্রত্যেককেই বন্ডে সই করতে হয়। তার শর্ত অনুযায়ী, কোর্স কমপ্লিট করার পর কোনও সরকারি হেল্থ সেন্টারে তিন বছর কাজ করতে তাঁরা বাধ্য থাকেন। না-হলে মোটা টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হয় তাঁদের।
কিন্তু কয়েক জন সিনিয়র রেসিডেন্ট ডক্টর সেটা মানছেন না বা তাঁদের ক্ষেত্রে ওই শর্ত প্রযোজ্য হচ্ছে না। তাঁরা পাশ করার পর প্রভাব খাটিয়ে সেই মেডিক্যাল কলেজেই থেকে যাচ্ছেন, সেখান থেকেই বেতনের টাকা তুলছেন। ওই আধিকারিকের কথায়, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মদত ছাড়া এটা কখনও সম্ভব নয়। তাই, তাঁরাও এর দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। যাঁরা মদত দিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’