হাসপাতালের মধ্যে এক তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার সূত্রে এখন আরজি করের বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়ম সামনে আসছে ঠিকই। তবে রাজ্যের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের অনিয়ম নিয়ে এক বছর আগেই সতর্ক করেছিল সিএজি বা ক্যাগ (কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল)।নবান্ন সূত্রের খবর, বছর খানেক আগেই ক্যাগের অডিট রিপোর্টে রাজ্যের একাধিক সরকারি হাসপাতালের অনিয়মের খবর জানা গিয়েছিল। ২০২৩ সালের ৫ অক্টোবর রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণস্বরূপ নিগমকে চিঠি দিয়ে এ ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন প্রিন্সিপ্যাল অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল। নবান্নের শীর্ষকর্তাদের একাংশের অভিমত— ক্যাগের অডিট রিপোর্ট সামনে আসার পর স্বাস্থ্য দপ্তরের তরফে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হলে সরকারকে এতটা বিড়ম্বনায় পড়তে হতো না।
রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হাল খতিয়ে দেখতে বছর খানেক আগে রাজ্যের মোট ৬টি মেডিক্যাল কলেজ এবং বিভিন্ন জেলা হাসপাতালে অনুসন্ধান চালায় ক্যাগ। সেগুলোর মধ্যে ছিল এসএসকেএম, জলপাইগুড়ি, রায়গঞ্জ, বসিরহাট, মেদিনীপুর এবং পুরুলিয়া ডিস্ট্রিক্ট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। ক্যাগের অনুসন্ধানে জানা গিয়েছে, ওই সব সরকারি হাসপাতালে নানা ধরনের অনিয়মের ঘটনা ঘটছে এবং আর্থিক ক্ষেত্রে অনেক ব্যাপারেই কোনও নিয়ম মানা হচ্ছে না।
চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রেও রয়েছে ব্যাপক ঘাটতি। রোগীরা উপযুক্ত পরিমাণ ও মানের খাবার পাচ্ছেন না। হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কেনা থেকে শুরু করে ওষুধ কেনা, চিকিৎসা বর্জ্যের ঠিকঠাক ব্যবস্থাপনা, লন্ড্রি পরিষেবা-সহ বিভিন্ন বিষয়ে ভূরি ভূরি অনিয়মের হদিশ পেয়েছেন ক্যাগের অডিটররা।
রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিবকে পাঠানো ক্যাগের রিপোর্ট অনুযায়ী, রাজ্যের মোট ৪২টি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে সব মিলিয়ে মোট ৪৪৫০ ধরনের যন্ত্রপাতি এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম রয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ১৫২ কোটি ৮৮ লক্ষ টাকা। সেই সব সরঞ্জাম সারা বছর রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য ২০২১ সালে একটি বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে তিন বছরের চুক্তি করেছিল স্বাস্থ্য দপ্তরেরই অধীন সংস্থা ওয়েস্ট বেঙ্গল মেডিক্যাল সার্ভিসেস কর্পোরেশন লিমিটেড।
চুক্তি অনুযায়ী, মাসের শেষে কাজ দেখে তাদের টাকা মেটানোর কথা থাকলেও বাস্তবে কাজ শুরু করার আগেই তাদের পেমেন্ট করে দেওয়া হয়েছে! এমনকী, যে সব চিকিৎসা সরঞ্জাম হাসপাতালের গুদামে বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে আছে, সেগুলোর জন্যও মেনটেন্যান্স চার্জ গুণতে হয়েছে সরকারকে।
রাজ্যের ১২টি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে অ্যানেসথেশিয়া ওয়ার্ক স্টেশন (ভেন্টিলেটর-সহ) বসানোর জন্য ২০১৬ সালে ই-টেন্ডার করা হয়। টেন্ডারের অন্যতম শর্ত ছিল, ওই সব সরঞ্জাম এফডিএ-র (ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) অনুমোদনপ্রাপ্ত হতে হবে। কিন্তু শুধু আবেদন করেই একটি ঠিকাদার সংস্থা ১ কোটি ৭০ লক্ষ টাকার বরাত পেয়ে গিয়েছে।
বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে খোঁজখবর নিয়ে ক্যাগের আধিকারিকরা জেনেছেন, হাসপাতাল চালানোর জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করে চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনা হলেও তার একটা বড় অংশই বিকল হয়ে পড়ে থাকছে। ফলে সেগুলো রোগীদের কোনও কাজেই লাগছে না। ক্যাগ রিপোর্ট অনুযায়ী, সরঞ্জাম রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ঠিকাদার সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হলেও ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত রাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালে মোট ৮৬৭০টি চিকিৎসা সরঞ্জাম বিকল অবস্থায় পড়ে ছিল।
রাজ্যের অর্থ দপ্তরের এক শীর্ষকর্তা বলেন, ‘হাসপাতালের এই সব অনিয়ম নিয়ে প্রিন্সিপাল অডিটর জেনারেল চিঠি দেওয়ার পরেই ভিজিল্যান্স তদন্ত শুরু হওয়ার কথা ছিল। তবে তার আগেই ওয়েস্ট বেঙ্গল মেডিক্যাল সার্ভিসেস কর্পোরেশনের এক শীর্ষ আধিকারিককে রাতারাতি সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ক্যাগ ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিলেও সেগুলোকে আর শোধরানোর চেষ্টা হয়নি। সে জন্য এখন সরকারের মুখ পুড়ছে।’
তবে ক্যাগের রিপোর্ট নিয়ে রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণস্বরূপ নিগম বলেন, ‘এই রিপোর্টের মধ্যে অনেক তথ্যগত ভুল রয়েছে। এ ব্যাপারে আমরা জবাব পাঠিয়ে দিয়েছি। বাকিটা ওদের ব্যাপার।’