বড় আশা করে রাত জাগল বাংলা, আরজি কর নিয়ে শুনানি আজ
এই সময় | ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪
এই সময়: আজ, সোমবার সুপ্রিম কোর্টে আরজি কর মামলার শুনানির দিকে তাকিয়ে গোটা দেশ। তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার পর থেকে যে প্রতিবাদ আছড়ে পড়েছে রাজপথে, এই শুনানির পরে তা কি কিছুটা হলেও প্রশমিত হতে চলেছে - প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছে সমাজের বিভিন্ন স্তরে। এই শুনানি হওয়ার কথা ছিল ৫ সেপ্টেম্বর।কিন্তু প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় অসুস্থ থাকায় তা পিছিয়ে যায়। তবে, ৫ তারিখকে সামনে রেখে ৪ সেপ্টেম্বর যে রাত দখল দেখেছিল শহর, রবিবার তার মাত্রা ও উদ্দীপনা ছিল আরও বেশি, দাবি উঠেছে এমনই। সুপ্রিম-শুনানির আগে রাজনীতিকে দূরে সরিয়ে রেখে যে বিনিদ্র রাত কাটালেন নাগরিকেরা, তা যাদবপুর, শ্যামবাজার, গড়িয়া, লেক টাউন, সোদপুর, ব্যারাকপুর থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল রায়গঞ্জ, কোচবিহার, নৈহাটি-সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে।
জাস্টিসের দাবিতে আজ, সোমবার ভোর দখলের সাক্ষী থাকতে চলেছে শিলিগুড়ি। রাজপথ দখলের এই স্বতঃস্ফুর্ত ছবি বলে দিচ্ছে, ওই মর্মান্তিক ঘটনার পরে এক মাস কেটে গেলেও জনতার ক্রোধ আর প্রতিবাদের উচ্চ লয় কাটার কোনও সম্ভাবনাই নেই। যে প্রতিথযশা চিকিৎসকদের সঙ্গে দেখা পেতে অপেক্ষা করতে হয় এক মাসেরও বেশি সময়, রবিবার দুপুরে রাজপথে দেখা গেল তাঁদেরও। লাইন করে স্লোগান দিয়ে হাঁটলেন তাঁরাও।
তাঁদের মুখে উঠে এল 'সিবিআই বিচার করো/কাউন্সিলের মাথা ধরো', 'আয় বিনীত দেখে যা/জনগনের ক্ষমতা'-র মতো স্লোগান। হাঁটতে দেখা গেল দু-বেলা দু'মুঠো খাওয়া রিকশাচালকদেরও। প্রশ্ন উঠেছে, যে ন্যায়-বিচারের আশা বুকে নিয়ে পথে নামছে, রাতের পর রাত জাগছে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ, আজ সুপ্রিম কোর্টের শুনানি থেকে এমন কিছু কি উঠে আসবে, যা থেকে কিছুটা হলেও জ্বালা জুড়োবে? প্রশ্ন উঠেছে, আর সেটা না-হলে কী হবে? শীর্ষ আদালতের কোনও পর্যবেক্ষণ যদি না-পসন্দ হয়, তখন কোন দিকে যাবে প্রতিবাদ-মিছিলের অভিমুখ?
আর এক মাস বাদেই পুজো। সাধারণত তার আগের রবিবারগুলোয় পুজোর বাজারে ব্যস্ত থাকা বাঙালি এ বার ন্যায় বিচার চেয়ে পথে। তবে কি কোথাও ফিকে হয়ে যাচ্ছে এ পুজোর যাবতীয় জৌলুস? অন্তত এ বছরটা আড়ম্বর কম হোক - আওয়াজ উঠছে বিভিন্ন পাড়ায়, আবাসনে। তবে, দুর্গাপুজোর জৌলুস যাতে এতটুকু না-কমে তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে 'ফোরাম ফর দুর্গোৎসব'।
রবিবার দুপুরে ফেসবুকে তাদের পক্ষ থেকে পোস্ট আসে - 'চালচিত্র থাকলে খালি/ভালো কি লাগবে বাঙালির?' খানিকটা প্রলেপ দেওয়ার মতো এর পরে লেখা হয়েছে, 'বিচার জুড়োক মেয়ের ক্ষত/পুজো ফিরুক আগের মতো।' ইতিমধ্যেই এই ফোরামের গায়ে লেগেছে রাজনৈতিক-ঘনিষ্ঠতার ছাপ। রবিবার তাদের এই পোস্টের পরে খানিকটা ঝাঁপিয়ে পড়েন নেটিজ়েনরা। দেওয়ালে উঠে আসে 'বাঙালির ঠেকা আপনাদের মতো শিরদাঁড়াহীন লোকেদের নিতে হবে না', 'এ বার না হয় আড়ম্বর একটু কম হোক', 'বাঙালির আবহমানের সংস্কৃতিকে আপনাদের কথায় চলতে হবে না।
সে ঠিক নিজের পথ খুঁজে নেবে। ন্যাকামোটা কম করুন', গোছের একের পর বিরূপ মন্তব্য। ১৪ অগস্ট স্বাধীনতার ঠিক আগে রাত দখলের ডাক দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী রিমঝিম সিনহা। যাদবপুর এইটবিতে ছিল সেই রাত দখলের ডাক। কিন্তু সেই স্ফুলিঙ্গই দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে। শহর, শহরতলি, জেলা ছাড়িয়ে মেয়েরা সারা দেশ এমনকী বিদেশেরও নানা প্রান্তে রাত দখলে নেমে পড়েন। তারপর গত ৪ সেপ্টেম্বর আরও একটি রাত দখল দেখেছে রাজ্যবাসী। তারপরে রবিবার।
রিমঝিমরাই এ দিন ফের রাত দখলের ডাক দেন। সেই ডাকেও সমান ভাবে সাড়া দিয়ে আরও বহু মানুষ, সংগঠন, ব্যক্তি এগিয়ে আসেন। কোথাও মশাল, কোথাও মোবাইলের ফ্লাশ লাইট ধরে, কোথাও গানে, কবিতা, স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে কলকাতা এবং জেলারও নানা প্রান্ত। সেলিব্রিটি থেকে সাধারণ মানুষ সবাই এক সঙ্গে এক যোগে নেমে পড়েন রাস্তায়। তাতে যোগ দেন নির্যাতিতার মা-বাবাও। বিকেলে ডাক্তারদের মিছিলের সামনেও ছিলেন তাঁরা।
রাসবিহারীর এক প্রতিবাদ মঞ্চ থেকে তাঁরা এ দিন আবার দাবি তোলেন প্রমাণ লোপাটের। কুর্নিশ জানান মানুষের এই প্রতিবাদকেও। সিমলা স্ট্রিটে দেখা গেল অশীতিপর বৃদ্ধা মঞ্জুবালা নিয়োগীকে। নাতনিদের সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন রাত দখলের ডাকে। বলছেন, 'সারা জীবনে অনেক বার উত্তাল কলকাতা দেখেছি। কিন্তু রাজনীতিকে বাইরে রেখে বার বার এমন ভাবে সাধারণ মানুষকে রাস্তায় নামতে দেখিনি। কোনও সরকারের বদল চাই না। আমরা বিচার চাই।'
লেক টাউন ঘড়ি মোড়ে তখন চলছে পথচিত্র আঁকার কাজ। সেখানেই দাঁড়িয়ে থেকে চিত্রশিল্পীদের জলের বোতল এগিয়ে দিচ্ছিলেন এক স্থানীয় দোকানি রামসুন্দর ত্রিবেদী। বলেন, 'এই ছেলেমেয়েগুলো অনেক করছে। সব মিছিল, মিটিংয়ে যেতে পারছি না। তাই জলের বোতল দিয়েই সাহায্য করছি।'
সোদপুর থেকে শ্যামবাজার- দীর্ঘ ১৪ কিলোমিটার রাস্তায় এ দিনই মানববন্ধনের সাক্ষী থেকেছে এই শহর। যাদবপুরের প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলেন বহু ব্যান্ড, সঙ্গীত শিল্পী। শ্যামবাজার মোড়েও শোনা গেল গান। তবে সেটা জাতীয় সঙ্গীত। জনগণের মন যে জাস্টিসের স্বরে সুর মিলিয়েই মুখরিত, সে কথাই যেন জানান দিয়েছেন তাঁরা।