• পছন্দমাফিক বদলি ৫-৮ লাখ টাকায়!
    এই সময় | ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • আরজি করের মেডিসিন বিভাগে দিব্যি চাকরি করছিলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ওই চিকিৎসক। আচমকাই একদিন সকালে তাঁকে অধ্যক্ষের কার্যালয়ে ডেকে 'রিলিজ অর্ডার' ধরিয়ে দেওয়া হলো। চিকিৎসক অবাক - বদলির অর্ডার ছাড়াই রিলিজ! উত্তর এসেছিল, বদলির অর্ডার এসে যাবে ঠিক।এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ওই চিকিৎসকের মোবাইলে ভেসে আসে অপরিচিত কণ্ঠস্বর - 'বদলির অর্ডার কাল বেরোবে। পুরুলিয়া যেতে হবে। যদি আটকাতে চান, তা হলে অমুক ব্যক্তির কাছে যেন কাল সকালের মধ্যে নগদ তিন লক্ষ টাকা পৌঁছে দেওয়া হয়।' শোনা যায়, ওইটুকু সময়ের মধ্যে অত টাকার ব্যবস্থা তিনি করতে পারেননি অথবা দিতেই চাননি। কারণ, শেষে পুরুলিয়াতে বদলি হতে হয় তাঁকে।

    এসএসকেএমের জেনারেল সার্জারির অ্যাসোসিয়েট প্রফেসরের ক্ষেত্রে অবশ্য রিলিজ অর্ডারও আসেনি। সরকারি চাকরির পাশাপাশি তাঁর প্রাইভেট প্র্যাকটিসও (সরকারের অনুমতি নিয়েই) ভালো। কোনও গৌরচন্দ্রিকা ছাড়াই বেজে ওঠে মোবাইল, 'দিন কয়েকের মধ্যে যে বদলির অর্ডার বেরোচ্ছে, তাতে আপনার নাম আছে। বদলি রামপুরহাট কিংবা কোচবিহারে হবে। ঠেকাতে চাইলে অমুক ব্যক্তির হাতে যেন চার লক্ষ টাকা নগদ তুলে দেওয়া হয়।' শোনা যায়, হাতে খানিকটা সময় পেয়ে বদলি আটকাতে ওই চিকিৎসক নাকি টাকা দিয়ে দিয়েছিলেন।

    কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ইএনটি বিশেষজ্ঞ সুদীপ দাস তথা সার্ভিস ডক্টর্স ফোরামের সহ-সভাপতি বলছেন, 'কে-ই বা চায় তাঁর পছন্দের শহর, যেখানে তাঁর ভালো প্র্যাকটিস জমে গিয়েছে, সেই শহর ছেড়ে অন্যত্র বদলি হয়ে যেতে! তাই টাকা দিয়েও দেন অধিকাংশ ডাক্তার।'

    এই টাকার বিনিময়ে বদলি আটকানো বা বদলি হওয়ার ঘটনার সঙ্গে সম্যক পরিচয় রয়েছে রাজ্যের সরকারি মেডিক্যাল এডুকেশন সার্ভিস ক্যাডারে কর্মরত চিকিৎসকদের। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ওই 'অমুক' ব্যক্তিটিও সরকারি চিকিৎসক। যে প্রভাবশালী গোষ্ঠী রাজ্য স্বাস্থ্য প্রশাসন ব্যবস্থার সব বিষয়ে ছড়ি ঘোরায়, ওই 'অমুক' চিকিৎসকেরা সেই গোষ্ঠীর অঙ্গুলিহেলনেই কাজ করে থাকেন।

    সরকারি চিকিৎসকরাই বলছেন, অভীক দে কিংবা বিরূপাক্ষ বিশ্বাস অথবা মুস্তাফিজুর রহমান মল্লিক - অমুক চিকিৎসকদের এই তালিকাটা মতো দীর্ঘ। টাকা পৌঁছে গেলেই হয়ে যেত সমস্যার সমাধান। আর টাকা দিতে না পারলে ঘোর অপছন্দের জায়গায় বদলি হয়ে যাওয়া একপ্রকার অনিবার্য। অভিযোগ, অভীকরা যেমন এই চক্রের সদস্য ছিলেন, তেমনই প্রভাবশালীদের নির্দেশ মতো এই টাকা কালেক্ট করার বেআইনি কাজ করতে বাধ্য হতেন একশ্রেণির চিকিৎসকেরা।

    অভিযোগ, সেই নির্দেশ অমান্য করলেও বদলির খাঁড়া ঝুলত তাঁদের মাথার উপরেও। স্বাস্থ্যভবনের কর্তারা বলছেন, চিকিৎসক মহলের একটা বড় অংশ দীর্ঘ দিন ধরেই সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের বদলি নীতি বা ট্রান্সফার পলিসি তৈরির পক্ষে সওয়াল করে এসেছেন। কিন্তু কোনও সরকারই সে কথা কানে তোলেনি।

    ফলে বাম আমল থেকেই সরকারি ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের বদলির বিষয়টি স্বাস্থ্য দপ্তরের অভ্যন্তরে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রিত হয়ে এসেছে। যার সঙ্গে আর্থিক লেনদেন বরাবরই সম্পৃক্ত। কিন্তু গত কয়েক বছর হলো টাকার অঙ্কটা আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে। এবং প্রাইভেট প্র্যাকটিসের কল্যাণে চিকিৎসকদের উপার্জন যেহেতু অন্যদের চেয়ে ঢের বেশি, তাই তাঁদেরই টার্গেট করা হয় সহজে।

    বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিক্যাল কলেজের জেনারেল সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক তথা অ্যাসোসিয়েশন অফ হেলথ সার্ভিস ডক্টর্সের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক মানস গুমটা কথায়, 'বদলি ইস্যুতে টাকা সব শাখার ডাক্তারদের কাছেই চাওয়া হয়। তবে প্রি বা প্যারা-ক্লিনিক্যাল শাখার চিকিৎসকরা যেহেতু তেমন প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন না, তাই ক্লিনিক্যাল শাখার চিকিৎসকদের থেকেই বদলি সংক্রান্ত ক্ষেত্রে বেশি টাকা চাওয়া হয়।'

    তিনি জানাচ্ছেন, এই সব ক্ষেত্রে ঝোপ বুঝে কোপ মারার প্রবণতাও লক্ষ্যণীয়। যার যত ভালো প্রাইভেট প্র্যাকটিস, তাঁর থেকে তত বেশি টাকা দাবি করা হয়। অবশ্য শুধু বদলি হয়ে যাওয়া চিকিৎসকদের বদলির অর্ডার প্রত্যাহারের জন্যই নয়, স্বেচ্ছায় বদলি চাওয়া চিকিৎসকদেরও খরচা আছে বিস্তর।

    কলকাতার চিকিৎসক মহানগর থেকে দূরে উত্তরবঙ্গ কিংবা পশ্চিমাঞ্চলের কোনও মেডিক্যাল কলেজে (বা উল্টোটা) দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করার পরে নিজের শহরে ফিরতে চাইলে, সেই ইচ্ছারও মূল্য চোকাতে হয় গড়ে পাঁচ থেকে আট লক্ষ টাকা খরচে। নইলে তিনি চোখের সামনে দেখতে পান, তাঁর চেয়ে কম দিন দূরে চাকরি করার পরেও অনেক সহকর্মী-সতীর্থ পছন্দের জায়গায় ট্রান্সফার পেয়ে যাচ্ছেন অদৃশ্য জাদুবলে। চিকিৎসকরা বলছেন, সেই জাদুবলের নাম কাঞ্চনমূল্য। (চলবে)
  • Link to this news (এই সময়)