এই সময়, কলকাতা ও নয়াদিল্লি: আরজি করের নিহত চিকিৎসকের দেহের ময়নাতদন্ত প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলল সুপ্রিম কোর্ট। ময়নাতদন্তের চালান কেস ডায়েরির সঙ্গে কেন দেওয়া হয়নি, সোমবার শুনানিতে তা জানতে চায় শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ।
রাজ্যের তরফে প্রবীণ কৌঁসুলি কপিল সিবালের উদ্দেশে বিচারপতি জেবি পারদিওয়ালার বক্তব্য, ‘পুলিশের তরফে মৃতদেহ নিয়ে ময়নাতদন্তে পাঠানোর সময়ে একজন কনস্টেবলের ওই ফর্ম সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু এখানে সেই ফর্মের কোনও উল্লেখ নেই। এই নথি যদি না পাওয়া যায়, তাহলে গুরুতর অভিযোগ উঠবে।’সিজেআই চন্দ্রচূড় নির্দেশ দেন, আগামী মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ওই নথি আদালতে হাজির করতে হবে। ওই দিনই মামলার পরবর্তী শুনানি। সে দিন সিবিআইকে তদন্তে অগ্রগতির রিপোর্টও দিতে হবে। যদিও রাজ্যের ব্যাখ্যা, কলকাতা পুলিশের ক্ষেত্রে এই চালান (ফর্ম-৫৩৭১) ছাপানো অনেক দিন হলো বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
এই ফর্মের পরিবর্তে কলকাতা পুলিশের তরফ থেকে লিখিত রিকুইজ়িশন পাঠানো হয় যে হাসপাতালে ময়নাতদন্ত হচ্ছে, তার বিভাগীয় প্রধানের কাছে। আরজি করের ঘটনার ক্ষেত্রেও তা-ই করা হয়েছে। আগামী শুনানিতেই রাজ্যের তরফে লিখিত ভাবে এই ব্যাখ্যা দেওয়া হবে।
শুধু ময়নাতদন্ত নয়, আরজি করের ধর্ষণ-খুন মামলার সার্বিক তদন্ত নিয়েই এ দিন একের পর এক প্রশ্ন তোলে শীর্ষ আদালত। নিম্ন আদালতে যেমন ভাবে তদন্তপ্রক্রিয়া নিয়ে কাটাছেঁড়া চলে, অনেকটা তেমনই ভাবে পুলিশি তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলেন মামলাকারীর আইনজীবীরা।
অকুস্থল থেকে কলকাতা পুলিশের অফিসাররা ঠিকমতো তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করেছিলেন কি না, সে প্রশ্নও ওঠে। সিবিআইয়ের তরফে সলিসিটার জেনারেল তুষার মেহতা জানান, পুলিশ যে নমুনা সংগ্রহ করেছিল, তা পরীক্ষার জন্য নতুন করে দিল্লি এইমস ও সেন্ট্রাল ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে (সিএফএসএল) পাঠাচ্ছে।
ধর্ষণ-খুন মামলায় প্রথমে তদন্ত শুরু করেছিল লালবাজারের বিশেষ তদন্তকারী দল বা সিট। এ দিন শুনানি চলাকালীন মামলাকারীদের তরফে অন্যতম আইনজীবী ফিরোজ এডুলজি যুক্তি দেন, ‘ময়নাতদন্তের সময়ে মৃতের গোপনাঙ্গ একটি রাসায়নিক দিয়ে ওয়াশ করে, রক্ত ও রক্তরস ন্যূনতম ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করার কথা। কিন্তু যে তিনজন চিকিৎসক ওই ময়নাতদন্তের দায়িত্বে ছিলেন, তাঁরা সেই ফ্লুইড বিধি মেনে সংরক্ষণ করেননি। ফলে ফরেন্সিক রিপোর্টে সঠিক তথ্য না আসার আশঙ্কা রয়েছে।’ তাঁর দাবি, এই তিন চিকিৎসকই তথাকথিত রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রশাসনের তথাকথিত উত্তরবঙ্গ লবির ঘনিষ্ঠ।
এই মামলায় তথ্যপ্রমাণ লোপাটের অভিযোগ বারবারই তুলেছেন আইনজীবীদের একাংশ। যদিও এ দিন নবান্নে প্রশাসনিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট জানান, ‘বলা হচ্ছে, এভিডেন্স লোপাট করা হয়েছে। কেন প্রমাণ লোপাট করব? কাকে বাঁচাব? কেউ আমাদের বন্ধু নয়, কেউ আমাদের শত্রুও নয়। আইন আইনের পথে চলবে। অনেকে অনেক উল্টোপাল্টা কথা বলে বেড়াচ্ছে। কিন্তু জেনে রাখুন, নো বডি ইজ় রিলেটেড টু মি। অ্যান্ড আই অ্যাম নট রিলেটেড টু এনিবডি। আমি যখন একটা চেয়ারে কাজ করি, সেই চেয়ারটাকে সম্মান দিতে জানি। অনেক অসম্মান অপমান করেছেন মিথ্যে কথা, কুৎসা রটিয়ে। আর করবেন না।’
আগের শুনানিতে সুপ্রিম কোর্ট প্রশ্ন তুলেছিল, আরজি করে ধর্ষণ-খুনের মামলায় কখন এফআইআর হয়েছে? পুলিশ জানায়, রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে এফআইআর হয়েছিল। যদিও এডুলজির যুক্তি, ‘বাস্তবে তা সম্ভব নয়। কারণ, ৯ অগস্ট সকালে দেহ উদ্ধারের পরেই পুলিশ ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদের ঘটনাস্থলে ডেকেছে। এফআইআর না করা পর্যন্ত সার্চ, সিজ়ার লিস্ট তৈরি, এমনকী ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞকে ডাকা ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা অনুযায়ী সম্ভব নয়।’
তাঁর অভিযোগ, আগের এফআইআর গোপন করে, রাতে নতুন করে এফআইআর করা হয়েছে। নিহত তরুণীর দেহের ময়নাতদন্তের সময়েই তাঁর পোশাক পাঠানোর কথা। কিন্তু পোশাক-সহ কী কী পাঠানো হয়েছিল ময়নাতদন্তের সময়ে, সেই কলাম ফাঁকা রয়েছে।
আদালত যে চালানের কথা উল্লেখ করেছিল, সেই প্রসঙ্গে এডুলজির বক্তব্য, কলকাতা হাইকোর্টে যখন আরজি কর মামলার শুনানি চলছিল, তখন কেস ডায়েরির মধ্যে ওই নথি পুলিশ দিয়েছিল। প্রয়োজনে কলকাতা হাইকোর্টের সেই শুনানির ভিডিয়ো রেকর্ডিং সুপ্রিম কোর্ট চেয়ে পাঠাতে পারে। সিবিআইয়ের তরফে সলিসিটার জেনারেল তুষার মেহতা তদন্তে অগ্রগতির রিপোর্ট জমা দেন আদালতে।
রিপোর্টের নির্দিষ্ট একটি অংশ চিহ্নিত করে আদালতকে তিনি বলেন, ‘রাজ্য পুলিশ মৃতদেহ থেকে যে নমুনা সংগ্রহ করেছিল, তা কলকাতার সিএফএসএলে পাঠানো হয়েছিল। তবে এই রিপোর্ট ত্রুটিপূর্ণ। তাই নতুন করে সিবিআই ওই নমুনা দিল্লির এইমস ও সিএফএসএলের অন্য শাখায় পাঠাচ্ছে। ফারাক থাকলে দু’টি রিপোর্ট দেখলেই তা বোঝা যাবে।’
মেহতার দাবি, কলকাতা পুলিশের তরফে যিনি নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন, তাঁকে চিহ্নিত করে কথা বলা হবে। যদিও বিস্তারিত শুনানির পরে প্রধান বিচারপতি জানান, আদালত এ নিয়ে প্রকাশ্যে কোনও পর্যবেক্ষণ দেবে না। তাতে তদন্তের ক্ষতি হতে পারে।
নিহত তরুণীর পরিবারের তরফে আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, ‘কলকাতা পুলিশের এক আইপিএস অফিসার নির্যাতিতার পরিবারকে মোটা টাকা দিতে চেয়েছিলেন।’ সিজেআই বলেন, ‘আমরা এ নিয়েও আলাদা করে কোনও নির্দেশ দেবো না। আশা করছি, আগামী দিনে সিবিআইয়ের তদন্ত রিপোর্টে বিষয়টির উল্লেখ থাকবে।’
এ দিন মুখ্যমন্ত্রী এই টাকার বিষয়টি নিয়েও মুখ খোলেন। কারণ, তিনিও নির্যাতিতার পরিবারকে ক্ষতিপূরণের কথা জানিয়েছিলেন বলে দাবি বিরোধীদের একাংশের। মমতার কথায়, ‘অনেকে বলে বেড়াচ্ছে না যে, আমি টাকার কথা বলেছিলাম। মিথ্যে কথা, কুৎসা। আমাকে কেউ প্রমাণ দেখাক! সে দিন (নির্যাতিতার বাড়িতে গিয়ে) আমি প্রেস কনফারেন্স করেছিলাম। আমার সঙ্গে সিপি ছিলেন। তার পরে আপনারা নির্যাতিতার বাবা-মাকেও জিজ্ঞেস করেছিলেন।’
মমতার সংযোজন, ‘তার আগের দিন রেসিডেন্ট ডক্টর্স ফোরাম আমার কাছে চিঠি দিয়ে একটা আবেদন করেছিল। তার তিন নম্বর পয়েন্টে ছিল, অ্যাডিকোয়েট কম্পেনসেশন টু দ্য ভিক্টিম ফ্যামিলি। কিন্তু তা-ও আমি বলিনি। আমি বাবা-মাকে বলেছিলাম, মৃত্যুর বিকল্প টাকা হয় না। আপনারা খুব মর্মাহত, আমরাও খুব মর্মাহত। কিন্তু তাও যদি আপনারা কোনও দিন মনে করেন যে, মেয়ের স্মৃতিতে কিছু করবেন, আমার সরকার আপনাদের পাশে আছে। নাথিং এলস।’
এডুলজি যুক্তি দেন, মৃতদেহ যে অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে তাতে হিপ বোন ভেঙে যাওয়ার কথা। যদি তা-ই হয়, সে ক্ষেত্রে মৃতদেহের এক্স রে করার কথাও। কিন্তু সিবিআইকে দেওয়া ময়নাতদন্তের রিপোর্টে এক্স রে রিপোর্ট আছে কি না, জানা নেই। তেমন কোনও এক্স রে প্লেট পাওয়ার কথা অস্বীকার করেন মেহতা। নির্যাতিতার দেহ উদ্ধারের পরদিন অকুস্থলের পাশে নির্মাণ ও সংস্কার কাজ নিয়েও এডুলজি প্রশ্ন তোলেন।
আততায়ীরা যদি খুনের পরে সেমিনার রুমের কাছের শৌচালয় ব্যবহার করেও থাকে, তাহলে ওই বাথরুমের বেসিন, মেঝেতে কোনও নমুনা থেকে থাকলেও ন্যুমিনাল টেস্ট (রক্ত বা এই ধরনের কোনও নমুনা মুছে ফেলার চেষ্টা হলেও যে পরীক্ষার মাধ্যমে তা উদ্ধার করা যায়) করলেও কোনও তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যাবে না। যদিও রাজ্যের তরফে সিবাল জানান, আইন মেনেই সব করা হয়েছে।
কোথাও কোনও ভুল-ত্রুটি থাকলেও তার ব্যাখ্যা আগামী দিনে দেওয়া হবে। আদালতের নির্দেশ মতো ৮ অগস্ট রাত থেকে ৯ অগস্ট পর্যন্ত হাসপাতালের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সিবিআইকে দেওয়া হয়েছে কি না, তা নিয়েও এ দিন রাজ্য ও সিবিআইয়ের মধ্যে মতপার্থক্য হয়। এই বিষয়টি নিয়েও আগামী মঙ্গলবার শুনানি হবে।
চালান ৫৩৭১ কী?
* অস্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে মৃতদেহ ময়নাতদন্তে পাঠানোর সময়ে এই চালান সঙ্গে নিয়ে যেতে হয় দায়িত্বে থাকা পুলিশকর্মীকে। সেই চালানে দেহের সঙ্গে মৃতের পোশাক-সহ আর কোন কোন জিনিস ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকদের কাছে পাঠানো হচ্ছে, তার তালিকা থাকে
* রাজ্যের ব্যাখ্যা, পশ্চিমবঙ্গ পুলিশে এই ফর্ম ব্যবহার হয়। তবে কলকাতা পুলিশে এই ফর্ম অনেক দিনই ব্যবহার হয় না। তার বদলে ময়নাতদন্তকারী হাসপাতালের বিভাগীয় প্রধানের কাছে লিখিত রিকুইজ়িশন দেওয়া হয়। এক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে
তদন্তে আর কোথায় প্রশ্ন—
* নির্যাতিতার বডি ফ্লুইড যে ন্যূনতম তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করার কথা, তা হয়নি
* এফআইআর করার আগেই কী ভাবে সার্চ-সিজ়ার
* মৃতদেহ ময়নাতদন্তে পাঠানোর সময়ে পোশাক পাঠানো হয়েছিল কি না, পরিষ্কার নয়
* কলকাতা পুলিশ যে ভাবে মৃতদেহ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে সিএফএসএলে পাঠিয়েছিল, তা ঠিক নয়