• ফসলের বিনিময়ে নদী পারাপার ‘দানের খেয়া’ আজও চলে সীমান্তে
    বর্তমান | ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • তামিম ইসলাম, ডোমকল: খেয়া নৌকা পারাপার করে নদীস্রোতে, কেহ যায় ঘরে, কেহ আসে ঘর হতে…। কিন্তু ঘাটে পারের কড়ি তো দিচ্ছেন কেউই! যে যাঁর মতো নৌকা থেকে নামছেন, চলেও যাচ্ছেন গন্তব্যে। তা হলে কী এই এলাকায় আজ প্রাচীন রীতি মেনে চলে ‘দানের খেয়া’? কিংবা বিনিময়ের খেয়া?

    নৌকা থেকে নেমে পায়ে পা মিলিয়ে যেতে যেতে এক যাত্রী বললেন, ‘ঠিকই ধরেছেন। আজও আমরা দানের খেয়াতেই পারাপার করে থাকি। মুখোমুখি দু’টি গ্রামের মাঝে এই নদী। দুই গ্রামেই কৃষি নির্ভর অর্থনীতি। আমরা প্রায় সকলেই কৃষক। প্রতিদিন কৃষির কাজে এপার-ওপার করতে হয়। তাতে প্রচুর খরচ। তাই এখানে খেয়া পারাপারে প্রাচীন রীতিই চলে আসছে। কৃষি জমিতে যাঁর যেমন ফসল হয়, তিনি বছর চুক্তিতে সেই ফসলের একটা অংশ ঘাট মালিকদের দিয়ে দেন। সেটা হতে পারে ধান কিংবা ডাল শস্য। কেউ আবার ফল-সব্জিও দিয়ে থাকেন। তবে, ঘাট মালিকদের ধানই বেশি পছন্দের।’ দেশে মুদ্রা প্রচলনের আগে এমনই বিনিময় প্রথাতেই খেয়া পারপার হতো। কৃষিজ ফসল মাঝিদের হাতে তুলে দেবেন যাত্রী। বিনিময়ে তিনি নদী পার করাবেন। যে প্রথাকে অনেক প্রাচীন গ্রন্থে ‘দানের খেয়া’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। 

    মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলা, রানিনগর, সাগরপাড়ায় বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষে প্রবাহিত হয়েছে পদ্মার শাখা নদী। স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ‘মরা পদ্মা’। ওপারেও ভারতীয় গ্রাম, প্রচুর কৃষি জমি রয়েছে। বছরের বেশিরভাগ সময়েই শাখা নদীতে জল থাকে। ফলে, মূল ভূখণ্ড থেকে নদীর ওপারে যেতে গেলে একমাত্র ভরসা খেয়া। পাড়ে তৈরি হয়েছে একাধিক ঘাট। বর্ষায় ঘাটগুলিতে নৌকার ব্যবস্থা থাকে। নদীতে জল কমে গেলে বাঁশের সাঁকোর ব্যবস্থা করে দেন ঘাটমালিকরা। প্রতিটি ঘাটে কমকরে গোটা পাঁচেক নৌকার ব্যবস্থা থাকে। 

    জানা গিয়েছে, এইসব ‘দানের খেয়া’তে পারানির কোনও বাঁধাধরা তালিকা কিংবা নিয়ম নেই। গ্রামবাসীরা বছরে নিজেদের সামর্থ্যমতো ঘাটমালিকদের ফসল দিয়ে থাকেন। সাধরণত চরের এলাকাগুলিতে ধান ও কলাইয়ের ভালো ফলন হয়। অনেকে এই দুটো ফসল বেশি চাষ করে থাকেন । কাজেই পারানি হিসেবে এই দু’টো ফসলই বেশি দিয়ে থাকেন গ্রামবাসীরা। একটি পরিবার বছরভর ঘাট পেরোনোর পারানি হিসেবে ২ মন ধান দিয়ে থাকেন। অর্থাৎ, বছরে ৮০ কাজ ধান। আর কেউ কলাই দিলে তার পরিমাণ ১০ কেজি। 

    বনমালীঘাট এলাকার বাসিন্দা নারায়ণ দাস। কথায় কথায় তিনি বলছিলেন, ‘আমাদের বাপ-ঠাকুর্দারা এভাবেই ফসলের বিনিময়ে খেয়া পেরোতেন। আমরা এখন পেরোচ্ছি। অনেক সমস্যা হয়। বিশেষ করে রাতবিরেতে প্রয়োজন পড়লে খেয়া পারাপার সম্ভব হয় না। তা হলেও ঐতিহ্য বয়ে নিয়ে যাওয়ার মধ্যে বেশ গর্ববোধ করি। গতবার আমি ধান দিয়েছিলাম।’ সাগরপাড়ার এক ঘাটমালিক সুরজিৎ মণ্ডলের কথায়, ‘আমাদের এখানকার প্রায় সকলেই কৃষিজীবী। পারানির বিনিময়ে ফসল দিলে তাঁদের সুবিধা হয়। আমরাও সেটাই গ্রহণ  করি। বহুকাল ধরে এই প্রথা চলে আসছে।’ 

    এই খেয়া চিরদিন চলে নদীর স্রোতে...। এটাই মরা পদ্মার অহঙ্কার।  নিজস্ব চিত্র
  • Link to this news (বর্তমান)