এই সময়: আর তো মাত্র এক মাস। পুজো আসছে। কিন্তু শহরের পথ জুড়ে এখনও আন্দোলনের ঢেউ। পুজোকে কেন্দ্র করে যে বিপুল ব্যবসা হয়, পথ দখলে প্রভাব পড়ছে সেই পুজোর বাজারেও। এমনকী, রাত দখলেও অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে অসুস্থ-বৃদ্ধদেরও। সোমবার নবান্নের প্রশাসনিক বৈঠকে এই অভিযোগ করে আন্দোলনকারীদের পুজো-উৎসবে ফিরতে অনুরোধ করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।জানালেন, কেউ কেউ পুজোর অনুদান যেমন ফেরাতে চেয়েছেন, তেমন অনেকে নতুন করে তা পাওয়ার জন্যও আবেদন করেছেন। সাধ্যমতো প্রশাসন তা দেওয়ার চেষ্টা করছে। জুনিয়র ডাক্তারদের দাবি মেনে আরজি করের অধ্যক্ষ-সহ অন্যান্য কর্তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে জানিয়ে মমতা বলেন, ‘এখন আমাদের হাতে কিছু নেই। সব কিছু সিবিআইয়ের হাতে।’ তার পরেও জোর করে রাজ্য জুড়ে আন্দোলন চালিয়ে পরিস্থিতি পরিকল্পিত ভাবে অস্থির করে তোলা হচ্ছে বলে অভিযোগ করলেন মুখ্যমন্ত্রী।
রাত দখলের কথা সরাসরি উল্লেখ না করলেও এ দিন মমতা বলেন, ‘প্রতিদিন রাতে আপনারা রাস্তায় থাকছেন। অনেক মানুষের তো অসুবিধা হয়। অনেক বয়স্ক মানুষ আছেন মাইকের আওয়াজে তাঁদের অসুবিধা হয়, ঘুম হয় না। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের নিয়ম আছে রাত ১০টার পরে মাইক বাজানো যায় না। তা সত্ত্বেও আমরা সব ছেড়ে দিয়েছি। এক মাস তো হয়ে গেল, এক মাস ১ দিন। আমি অনুরোধ করব, পুজোতে ফিরে আসুন, উৎসবে ফিরে আসুন।’
মমতার এই বক্তব্যের সমালোচনা করে সোস্যাল মিডিয়ায় উঠে আসে বহু পোস্ট। লেখা হয়, ‘উৎসবে ফিরছি না, উৎসবেই আছি। জন-জাগরণের উৎসবে আছি, তিলোত্তমার সুবিচারের দাবির উৎসবে আছি.....।’ নির্যাতিতার মা বলেন, ‘আমার বাড়িতেও দুর্গাপুজো হতো। আমার মেয়ে করত। কিন্তু আমার বাড়িতে আর কোনও দিন দুর্গাপুজোর আলো জ্বলবে না। আমি কী করে মানুষকে বলব উৎসবে ফিরতে?’ তাঁর প্রশ্ন ‘মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারে যদি এমন ঘটনা ঘটত, তা হলে কি উনি এ কথা বলতে পারতেন?’
এই প্রসঙ্গে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেন, ‘আপনি কি জনগণকে হাতের পুতুল পেয়েছেন? আপনি উঠতে বললে উঠবে, বসতে বললে বসবে। উৎসবে মেতে উঠতে বললে মেতে উঠবে, আন্দোলন বন্ধ করতে বললে বন্ধ করে দেবে? এখনও তো দেবীপক্ষের সূচনা হয়নি, অসুরের বিনাশ বাকি রয়েছে। একটু ধৈর্য ধরুন, মাতৃশক্তি জাগ্রত হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গকে স্বচ্ছ করেই ছাড়বেন।’ সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, উৎসবে ফিরুন। মানুষ কিন্তু বিচার চাইছে। উৎসবেও তারা নিজের দুর্গার সুরক্ষা চায়। অসুর বিনাশী দুর্গাকে চায়।’
আরজি করের ঘটনার পরে কয়েকটি ক্লাব পুজোর অনুদানের টাকা নেবে না বলে ঘোষণা করেছে। এই প্রসঙ্গে মমতা এ দিন বলেন, ‘পুজোর টাকার অনুদান নিয়ে আমাদের কাছে আরও কিছু অনুরোধ এসেছে। আমাদের সাড়ে চারশো কোটি টাকার মতো খরচ হচ্ছে ক্লাবগুলোকে দিতে। সেই টাকাটা আগামী কাল থেকে ছাড়বার জন্য আমি বলে দিচ্ছি।’ এর পরেই তিনি বলেন, ‘যদি কেউ তা না-নিতে চান, ওয়েল অ্যান্ড গুড। তাঁদের সামর্থ্য আছে। আমি প্রশাসনকে বলব, আপনাদের কাছে যে নতুন লিস্ট আছে, তাদের (অনুদান) দিয়ে দেবেন। সবাইকে হয়তো পারব না একবারে। আসলে টাকাটা অলরেডি অনেকটা বেড়ে গিয়েছে।’
আন্দোলনের জেরে রাজ্যে পুজোর বাজার যে ধাক্কা খাচ্ছে, তা ব্যবসায়ীরাও জানাচ্ছেন। মমতাও এ দিন সেই প্রসঙ্গে তুলে বলেন, ‘পুজোর সময়ে বাজারে গতি আসে। কিন্তু কেউ কেউ রাজ্যে ইকোনমিক ডেস্ট্রাকশন চাইছেন।’ এর পরেই তাঁর প্রশ্ন, ‘আপনারা কি বিচার চান, নাকি কেসটাকে ঝুলিয়ে দিতে চান? আমাদের হাতে এখন আর কিছু নেই।’ আন্দোলন নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, ‘পুলিশের অনুমতিও নেওয়া হচ্ছে না। দুর্ভাগ্যবশত অনেকে উপর থেকে অনুমতি নিয়ে আসছেন। বিচারের বাণী নিরবে-নিভৃতে কাঁদে। এতে আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা হচ্ছে। অন্য রাজ্যে কিন্তু এটা করা যায় না।’
আন্দোলন সামলানো সম্পর্কে মমতা বলেন, ‘পুলিশ শান্তিপূর্ণ ভাবে সব সামাল দিয়েছে। নিজেরা মার খেয়েছে। কিন্তু কারও রক্ত নেয়নি। তার জন্য আমি প্রশংসা করি পুলিশের। সঙ্গে আপনাদেরও বোঝা উচিত। পুলিশ সারাক্ষণ আপনাদের পাহারা দেয়। তারাও আপনাদের মতোই মানুষ। যাঁকে পাচ্ছেন, যা ইচ্ছা বলে যাচ্ছেন! এক বারও ভাববেন না যে, আপনাদের পরিবার তুলে যদি কেউ এই কথা বলে, আপনাদের কেমন লাগবে? আপনাদের মানসিকতা কী হবে?’ তাঁর কথায়, ‘বাংলার নামে বদনাম করা হচ্ছে সারা পৃথিবীতে। একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ জুটেছে। তাঁরা এখান থেকে পড়াশোনা করে, খেয়েদেয়ে মানুষ হয়ে বাইরে গিয়েছেন। গিয়ে একতরফা বাংলার বদনাম করছেন। তাঁরা তো দু’পক্ষের কথা শুনছেন না!’
কিছুটা আক্রমণের সুরেই তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের পরে আপনারা এই সুযোগটা নিচ্ছেন তো? বাংলাদেশ আলাদা রাষ্ট্র। আমরা তাদের ভালবাসি, সম্মান করি। ভারত আলাদা রাষ্ট্র। এই দু’টো মাথায় রাখতে ভুলে গিয়েছেন। এখানে বাংলাদেশ হবে না।’ কিছুটা আক্রমণের সুরেই মমতা বলেন, ‘এর মধ্যে কিছু বাম দল রয়েছে। মানুষের কাছে যাওয়ার ক্ষমতা নেই। লোক ক্ষেপিয়ে শুধু পরিস্থিতি অশান্ত করার অপচেষ্টা।’