এ বার উৎসবে ফিরুন — ডাক দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নেট মাধ্যমে পাল্টা যুক্তি উঠে এসেছে — ‘বিকেলের খেলা শেষ, এ বার পড়তে বোসো’-র মতো শুনতে লাগছে কথাটা। মিছিলে হাঁটা সাধারণ মানুষের দাবি, নাগরিক কখন মিছিল করবেন, কখন উৎসব করবেন, কখন প্রতিবাদ করবেন, সেটাও কি ঠিক করে দেওয়া হবে?বাঙালির প্রাণের উৎসব দুর্গাপুজো। জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ এই উৎসবে শামিল হন। তা নিয়ে বাঙালির সেন্টিমেন্টের অন্ত নেই। কিন্তু আবহ বদলে গিয়েছে। রাজ্যবাসীর একটা অংশ মনে করছে, আরজি কর কাণ্ডের পরে, এখনও সে ভাবে বিচার না-পাওয়ায়, ঢাক-ঢোল বাজিয়ে, আলোর মালা দিয়ে কি এ বার দুর্গাপুজোর জৌলুসে নেচে ওঠার মতো মন রয়েছে মানুষের? আর এই প্রেক্ষিতেই উঠে আসছে প্রশ্ন, তবে কি কিছুটা হলেও ভাটা পড়বে এ বারের পুজোয়?
মঙ্গলবার বিকেলের পর থেকে স্বাস্থ্য দপ্তরের কর্তাদের অপসারণ চেয়ে সল্টলেকের স্বাস্থ্যভবনের সামনে ধর্নায় বসেছেন জুনিয়র ডাক্তাররা। সন্ধের পর থেকে তাঁদের সমর্থন যোগাতে সেখানে ভিড় জমাতে শুরু করেন সাধারণ মানুষ। নবান্ন থেকে আলোচনার জন্য ডেকে পাঠালেও যাননি জুনিয়র ডাক্তাররা। সোমবারেও তাঁদের কাজে ফিরতে আহ্বান জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেছিলেন, ‘এক মাস হয়ে গিয়েছে, এ বার উৎসবে ফিরুন।’
আর তাঁর এই মন্তব্য নিয়েই এখন সরগরম রাজ্য। নানা ধরনের স্লোগান, মিম, কার্টুনে ভরে গিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়াল। উৎসব নিয়ে বিভাজন তৈরি হয়েছে আন্দোলনকারীদের মধ্যেও। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকের মন্তব্য, ‘উৎ-শবে ফিরুন!’ কেউ আবার ‘উৎসবে ফিরবো না’ বলে ঘোষণাও করে দিয়েছেন। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতার লাইন ধার করে কেউ লিখছেন, ‘ভয় করলেই ভয়।’
আবার মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের পক্ষেও অনেকে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। তাঁদেরই কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন, ‘যাঁরা উৎসব বয়কট করছেন, তাঁরা কি সরকারের দেওয়া বোনাসটাও প্রত্যাখ্যান করছেন? যাঁরা উৎসব বয়কটের ডাক দিচ্ছেন তাঁরা বিয়েবাড়ি, অন্নপ্রাশনের মতো পারিবারিক অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলছেন?’ অনেকে মধ্যপন্থাও নিচ্ছেন। তাঁরা বলছেন, উৎসব চলুক। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলুক প্রতিবাদও। তাঁদের স্লোগান, ‘গরিবের উপকার মহৎ কাজ, সঙ্গে তিলোত্তমাও বিচার পাক।’
মেডিক্যাল সার্ভিস সেন্টারের রাজ্য সম্পাদক বিপ্লব চন্দ্র বলেন, ‘এরকম একটা শোকের আবহে মুখ্যমন্ত্রী উৎসব করতে বলছেন, এটা খুবই দুর্ভাগ্যের। উনি বাঙালির আবেগে আঘাত করেছেন। কারও বাড়ির মেয়েকে যদি এ ভাবে হত্যা করা হয়, তিনি কি উৎসবে শামিল হতে পারবেন?’ আরজি কর আন্দোলনের পরিচিত মুখ ছন্দক চট্টোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা, ‘উৎসবের মধ্যেও এই আন্দোলন চালানো যায়। আমরাও যখন ছাত্র ছিলাম তখনও উৎসবের মধ্যেই আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে আন্দোলনের সময়সীমা ঠিক করে দিচ্ছেন, তা মানা যায় না।’
আরজি করে কাণ্ডের প্রতিবাদে যিনি প্রথম রাত দখলের ডাক দিয়েছিলেন সেই রিমঝিম সিনহা বলছেন, ‘এই আন্দোলন গণ-জাগরণের মহোৎসব। ‘উৎসব’ নিজের মতন করে সাধারণ জনগণই তৈরি করেছেন। তারা পথে থাকছেন, বিচার চাইছেন।’ সবাইকে ‘উৎসব’-এ ফেরার ডাক দিয়ে মঙ্গলবার রাতে মধ্যমগ্রাম শহরে পথে নামেন একদল মানুষ। ঢাক, ঢোল, কাসর, ঘণ্টা বাজিয়ে, শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনির মাধ্যমে ‘উই ডিমান্ড জাস্টিস’-র দাবিতে সোচ্চার হতে দেখা যায় তাঁদের।
ফোরাম ফর দুর্গোৎসবের সম্পাদক শাশ্বত বসু বলেন, ‘আমরাও আরজি করের ঘটনার বিচার চাইছি। কিন্তু এর সঙ্গে পুজোকে জড়িয়ে দেওয়া ঠিক হবে না।’ তৃণমূলের রাজ্যসভার প্রাক্তন সদস্য কুণাল ঘোষ বলেন, ‘এটা নিয়ে বিতর্কের কোনও জায়গা নেই। উৎসব বলতে মুখ্যমন্ত্রী ব্যাপক অর্থনীতির কথা বলতে চেয়েছেন। পুজো মানে শুধু উৎসব নয়, এর সঙ্গে অর্থনীতি জড়িয়ে আছে। প্রচুর হস্তশিল্পী, ছোট ছোট দোকানদার এবং শিল্পীদের স্বার্থ জড়িত। প্রতিবাদের নামে কয়েক লক্ষ মানুষের রুটি-রুজি বন্ধ করে দেওয়া ঠিক হবে না।’
বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেন, ‘বাঙালি কী করবে সেটা ঠিক করার মালিক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নয়।’ বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের কথায়, ‘এ বার মানুষ মন খারাপ নিয়ে উৎসব পালন করবে।’