এই সময়: বিচার বিভাগের উপর চাপ তৈরি করতে দুষ্কৃতী ও পুলিশের একাংশের আঁতাঁতের গুরুতর অভিযোগ তুললেন বিচারকরাই! এমন বেনজির অভিযোগ তুলে বুধবার কলকাতা হাইকোর্টকে চিঠি দিলেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলা জজ। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, দুষ্কৃতীদের হামলার আশঙ্কায় নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন ডায়মন্ড হারবার মহকুমা আদালতের বিচারকরা।গত ৮ সেপ্টেম্বর ডায়মন্ড হারবারে বিচারকদের আবাসনে কিছু দুষ্কৃতী ঢোকার চেষ্টা করেছিল বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। হাইকোর্টের নির্দেশে এ দিন বিকেলেই দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলা জজ শুভ্রদীপ মিত্র ডায়মন্ড হারবারে গিয়ে সেখানকার বিচারক এবং পুলিশ ও মহকুমাশাসকের সঙ্গে বৈঠক করেন।
যদিও বিচারকদের অভিযোগের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে এদিন মহকুমা আদালত চত্বরে বিক্ষোভ দেখান ডায়মন্ড হারবার ক্রিমিন্যাল কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের আইনজীবীদের একাংশ। পুলিশ অবশ্য বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েই দেখছে।
ডায়মন্ড হারবারের পুলিশ সুপার রাহুল গোস্বামী বলেন, ‘বিচারকদের আবাসনে বেআইনি ভাবে ঢোকার চেষ্টার অভিযোগে এক সন্দেহভাজনকে আটক করা হয়েছে। যে পুলিশকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তাঁদের শো-কজ় করা হয়েছে। সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ওই আবাসনের নিরাপত্তা আরও বাড়ানো হয়েছে।’
ঠিক কী অভিযোগ বিচারকদের?
হাইকোর্টের কাছে পাঠানো চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, পুলিশের একাংশের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে দুষ্কৃতীরা বিচারব্যবস্থাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে এবং সেটা কোনও ব্যক্তিগত ইস্যুর জন্য নয়। বিচারকদের বক্তব্য, দিন কয়েকের মধ্যে কয়েকটি পকসো মামলায় রায়ের প্রেক্ষিতেই বিচারকদের উপরে এই ভীতি প্রদর্শনের চেষ্টা হয়েছে। অভিযোগ, গত রবিবার রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ ডায়মন্ড হারবার শহরে বিচারকদের আবাসনে ঢোকার চেষ্টা করে দুই অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি।
তারা এক বিচারকের কোয়ার্টারের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য জোর করে ঢোকার চেষ্টা করে। পৈলান থানার এক সাব ইনস্পেক্টরের নাম করে আবাসনের নিরাপত্তারক্ষীদের গেট খোলার জন্য হুমকি দেয়। চিঠিতে এও বলা হয়েছে, ডায়মন্ড হারবারের এসিজেএম ওই রক্ষীদের কাছ থেকে জানতে পারেন, পৈলানের ওই পুলিশ অফিসার সঙ্গে ডায়মন্ড হারবার থানার এক আধিকারিকের যোগসাজশ রয়েছে। নিজেদের নামও জানাতে অস্বীকার করে আগন্তুকরা।
যদিও নিরাপত্তারক্ষীরা তাদের ঢুকতে দেননি। আবাসনের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ থেকেও অভিযোগের সত্যতা মিলবে বলে দাবি বিচারকদের। বিষয়টি নিয়ে ওই রাতেই এসিজেএম কথা বলেন অতিরিক্ত জেলা জজের সঙ্গে।
এর ঘণ্টা দেড়েক বাদে রাত একটা নাগাদ আর এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে মুখ ঢাকা অবস্থায় ওই আবাসনের গেটের বাইরে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। ফের আবাসনের গেট খুলে দেওয়ার জন্য নিরাপত্তারক্ষীদের হুমকি দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। বিষয়টি জানার পরেই এসিজেএম ফোন করেন থানার আইসিকে। কিন্তু দু’বার ফোন করার পরে প্রায় ২০ মিনিট বাদে ডায়মন্ড হারবার থানার আইসি ঘটনাস্থলে আসেন।
তিনি আরও বেশ কিছু পুলিশকর্মীকে সেখানে ওই রাতে পোস্টিং দিয়ে যান। ততক্ষণে অবশ্য অভিযুক্ত পালিয়ে যায়। ওই আবাসনে মহকুমা আদালতের বিভিন্ন পদের জনা দশেক বিচারকের কোয়ার্টার রয়েছে। হাইকোর্টকে দেওয়া চিঠিতে বিচারকদের আশঙ্কা, অত রাতে যারা তাঁদের আবাসনে ঢুকে হুমকি দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে, তাদের সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্রও থাকতে পারে।
বিচারকদের অভিযোগ উড়িয়ে ডায়মন্ড হারবার ক্রিমিন্যাল কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক প্রীতবাস মণ্ডল বলেন, ‘বিচারকদের আবাসনে হামলার ঘটনা বার অ্যাসোসিয়েশনকে জানানো হয়নি। কাল্পনিক অভিযোগ করে ডায়মন্ড হারবার আদালতকে কলুষিত করা হচ্ছে।’
রাজ্যসভায় তৃণমূলের প্রাক্তন সাংসদ কুণাল ঘোষের যুক্তি, ‘বিচারকদের উপরে হামলা বা তাঁদের রায়ের উপর আক্রোশের জেরে এমন কোনও ঘটনা একেবারেই নয়। এক ব্যক্তিকে ওই আবাসনের বাইরে একটু অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় দেখা গিয়েছে। এটা একেবারেই ব্যক্তিগত বিষয়। কোনও হামলার চেষ্টার মতো কিছু নয়।’
পুলিশ যে ব্যক্তিকে আটক করেছে, তাঁকে আবার ক্যামেরার সামনে বলতে শোনা যায়, ‘আমি একটু নেশা করে সে দিন ঢুকে পড়েছিলাম। আমার কোনও উদ্দেশ্য ছিল না। আমাকে কেন পুলিশ ধরে নিয়ে এল, জানি না।’
বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার অবশ্য এই ঘটনার কথা জানিয়ে কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী অর্জুনরাম মেঘওয়ালের কাছে অভিযোগ করেছেন, ‘এখানে আইন-শৃঙ্খলার এমনই অবস্থা যে বিচারকরাও নিরাপদ নন।’
পাল্টা রাজ্যের মন্ত্রী শশী পাঁজার বক্তব্য, ‘আর কতদিন আপনারা মিথ্যা প্রচার করবেন? বিচারকের উদ্বেগের বিষয়টি পুলিশ ইতিমধ্যে দেখছে। তাঁর বাড়ির নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট অফিসারের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’