• পথে জুনিয়র ডাক্তার, ওয়াশরুম থেকে খাবার-জল, পাশে কমন ম্যান
    এই সময় | ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • এই সময়: মঙ্গলবার রাত প্রায় এগারোটা। ফোনে জানতে চাইলেন বিমানবন্দরের অফিসার কৈলাশপতি মণ্ডল, ‘ছেলেমেয়েগুলো পথে রাত জাগছে। ওদের কি খাবার বা জল লাগবে? এখনই পৌঁছে দিতে চাই।’ সিনিয়র মহিলা পালমোলজিস্ট সুস্মিতা রায়চৌধুরী উদ্বিগ্ন কণ্ঠে ফোনে জানতে চান, ‘এই স্বাস্থ্যভবনের কাছাকাছি কোথাও মেয়েগুলোর জন্য ওয়াশরুমের ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন?’ সল্টলেকের বাসিন্দা, ইঞ্জিনিয়ার কস্তুরী বসু বললেন, ‘আমি জল নিয়ে বেরিয়ে পড়ছি।’শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণ, বহু মানুষ যে কোনও ভাবে আন্দোলনের গায়ে গা-লাগিয়ে দাঁড়াতে চাইছেন। সেই ওমটা ছড়িয়ে যাচ্ছে রাত-জাগা উজ্জ্বল চোখগুলোয়। কথার কথা নয়। রাজপথে রাত জাগতে ছেলে-মেয়েদের যা যা প্রয়োজন হতে পারে, সে সবই পৌঁছে যাচ্ছে জুনিয়র ডাক্তারদের কাছে।

    সন্ধ্যেয় যেখানে মেয়েগুলোকে ওয়াশরুম খুঁজতে এদিক-সেদিক ছুটতে হচ্ছিল, সল্টলেক সেক্টর ফাইভে স্বাস্থ্যভবনের সামনে সেই রাস্তার একপাশে মঙ্গলবার রাত দু’টো নাগাদ দেখা গেল বায়ো-টয়লেটের সারি। মোট ১৩টা। বুধবার সন্ধ্যেয় সংখ্যাটা আরও বেড়েছে। আন্দোলনের অন্যতম মুখ কিঞ্জল নন্দ বলেন, ‘মানুষ যে ভাবে আমাদের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে তাতে আমরা অভিভূত। তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই। আর এটাই আমাদের প্রধান শক্তি।’

    লালবাজারে যে দিন অভিযান করেছিলেন জুনিয়র ডাক্তাররা, সেই ২৬ অগস্ট রাতেও বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিট ও ফিয়ার্স লেনের মোড়ে সারা রাত জেগেছিলেন তাঁরা। তখন আশপাশে বাড়ি থেকে এগিয়ে এসেছিল সাহায্যের হাত। বেশ কয়েকটি বাড়ির সদর দরজা হাট করে খুলে দিয়ে বলা হয়েছিল, ‘তোমরা যে কোনও প্রয়োজনে চলে এসো।’

    মেয়েগুলোর ওয়াশরুমের অভাব হয়নি। কিন্তু, স্বাস্থ্যভবনের আশপাশের পুরোটাই অফিস-পাড়া। সারা রাত সে সব বাড়ি ভুতের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। সেই সব বাড়ির কেয়ারটেকারদের কাছে মঙ্গলবার রাতে অনুনয় করা হলেও অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন ‘অজানা’ এক আশঙ্কায়। এটা যে হতে পারে, মঙ্গলবার বিকেলের পর থেকেই তা অনুধাবন করতে শুরু করেন নগরবাসী। আর তখনই শুরু হয় একের পর এক ফোন — ‘কী লাগবে বলুন।’ টিভিতে পরিস্থিতি দেখে গাড়ি হাঁকিয়ে অনেকেই খাবার-জল নিয়ে পৌঁছে যান সেক্টর ফাইভে।

    অথচ আন্দোলরত পড়ুয়াদের সঙ্গে এঁদের কোনও পূর্ব পরিচয় নেই। কেউ কাউকে কোনও দিন চোখেও দেখেননি। তাঁদের নামটা পর্যন্ত শোনেননি। সেই অচেনা সহ-নাগরকিরাই ধর্নায় বসা জুনিয়র ডাক্তারদের কাছে আপনজন হয়ে উঠছেন। জুনিয়র ডাক্তারদের যাতে অভুক্ত থাকতে না হয়, তার জন্য বুধবার সকাল থেকে কেউ নিজের পকেটের টাকা খরচ করে বিরিয়ানির প্যাকেট নিয়ে এসেছিলেন, কেউ এনেছিলেন বিস্কুট, শুকনো খাবার, ন্যাপকিন ও জলের বোতল। ঝাঁ-ঝাঁ রোদে কেউ আবার আন্দোলনকারীদের হাতে তুলে দিয়েছেন হাতপাখা।

    বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থাও নানা ভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। বিদেশ থেকেও মিলছে সাহায্য। মানুষের এই স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দেখে অভিভূত শহরবাসীরাও। আরজি করের নির্যাতিতার ন্যায়বিচার-সহ একগুচ্ছ দাবিতে মঙ্গলবার থেকে স্বাস্থ্যভবনের সামনে ধর্নায় বসেছেন জুনিয়র ডাক্তাররা।

    এই আন্দোলন দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে ভেবে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে করে শুকনো খাবার, জল, পোশাক-সহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, মঙ্গলবার রাত থেকে সাধারণ মানুষ যে ভাবে তাঁদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, তাতে সেগুলো আর ব্যাগ থেকে বেরই করতে হয়নি।

    দক্ষিণবঙ্গ থেকে এখনও বর্ষা বিদায় নেয়নি। কলকাতাতেও মাঝে মধ্যেই বৃষ্টি হচ্ছে। এই অবস্থায় খোলা রাস্তায় কী ভাবে ধর্না চালানো যাবে তা নিয়ে সংশয়ে ছিলেন আন্দোলনকারীরা। সেই দুশ্চিন্তা অনেকটাই দূর করে দিয়েছেন এক ডেকরেটার। মঙ্গলবার রাত দেড়টা নাগাদ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়তে শুরু করে।

    অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে মাথার উপরে একের পর এক ত্রিপল টাঙিয়ে দিতে দেখা যায় ডেকরেটার-কর্মীদের। রাস্তায় বসার জন্য প্লাস্টিক বিছিয়ে দিয়েছেন তাঁরাই। বায়ো টয়েলেটেরও ব্যবস্থা হয়েছে দ্রুত। ভ্যাপসা গরমের হাত থেকে বাঁচতে বড় বড় স্ট্যান্ড ফ্যানেরও ব্যবস্থা করে দিয়েছেন এক ডেকরেকটর সংস্থার মালিক। যদিও সংবাদমাধ্যমে নিজের নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি তিনি। সেই ‘অজানা ভয়’।

    আন্দোলস্থল থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে রয়েছে টেকনো ইন্ডিয়া ইউনিভার্সিটি। তাদের তরফ থেকে আন্দোলনকারীদের জন্য বুধবার দুপুরের খাবার পাঠানো হয়েছিল। ছিল ভাত, ডাল সব্জি, ডিমের কারি, খিচুড়ি ও তরকারি। এরকম অজস্র সংস্থা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। সল্টলেকের একটি বেসরকারি কর্পোরেট সংস্থা থেকে মোট ৫০০ প্যাকেট এবং অন্য একটি সংস্থা থেকে ২৫০ প্যাকেট বিরিয়ানি পাঠানো হয়েছিল। ব্যক্তিগত উদ্যোগেও অনেকে খাবার নিয়ে এসেছিলেন।

    ইএম বাইপাসের সাপুইপাড়ার বাসিন্দা সুপর্ণা দাশগুপ্ত-র মেয়ে এনআরএসের অঙ্কোলজি বিভাগের চিকিৎসক। তিনি সঙ্গে করে এনেছিলেন ৫০ প্যাকেট বিরিয়ানি, কোল্ড ড্রিঙ্কস এবং খাবার জল। অবসরপ্রাপ্ত দম্পতি, অধ্যাপক দিলীপ খাঁ এবং শিক্ষিকা কৃষ্ণা খাঁ গাড়ি বোঝাই করে ছ’পেটি জলের বোতল আনেন। গ্লুকোন-ডির প্যাকেট, বিস্কুট এবং শুকনো খাবার নিয়ে এসেছিল মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভদের একটি গ্রুপ। কলকাতার রমরমা নাটকের দলের পক্ষ থেকে তুলে দেওয়া হয় হাতপাখা এবং তোয়ালে। তালিকাটা দীর্ঘ......
  • Link to this news (এই সময়)