• ছ’মাসে খোলা বাজারে বিক্রি ১ লক্ষ কেজি চিকিৎসা-বর্জ্য!
    এই সময় | ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • সিঙ্গুর, তিলজলা, চৌবাগা। এই তিনটি জায়গার যোগসূত্র কী?

    যোগসূত্র হলো আরজি কর, যে হাসপাতাল এই তিনটি জায়গাকে এনে ফেলেছে এক বিন্দুতে। ছ’ মাসে ওই হাসপাতাল থেকে পাচার হওয়া অন্তত ১ লক্ষ কেজি চিকিৎসা-বর্জ্য জমা হতো এই তিনটি জায়গায়। তার পর বিক্রি হয়ে যেত বিভিন্ন গন্তব্যে।বিপুল সংখ্যায় রোগী ভর্তি থাকে আরজি করে। প্রতিদিন অন্তত দু’ হাজার রোগীর চিকিৎসা হয় সেখানে। ফলে বিপুল পরিমাণ চিকিৎসা-বর্জ্যও জমে ওই হাসপাতালে। দিনে প্রায় ৩০০ কেজি। কিন্তু এর দুই-তৃতীয়াংশ বর্জ্য-ই আরজি কর থেকে পাচার হয়ে যেত হুগলি ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার কয়েকটি জায়গা ছাড়াও বাংলাদেশে। কিছুটা বিক্রি হতো খোলা বাজারে।

    দুর্নীতির তদন্তে নেমে এমনই ভয়াবহ চক্রের হদিশ পাওয়া গিয়েছে বলে খবর কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে। চিকিৎসকরা শঙ্কিত, এই পাচারের জেরে অজান্তেই সাধারণ মানুষ পড়তে পারেন ভয়ঙ্কর সংক্রমণের কবলে! আরজি করের কাছাকাছি শয্যা সংখ্যার আর এক সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল হলো এনআরএস। স্বাস্থ্য দপ্তরের হিসেব, সেখানে গড়ে প্রতি মাসে ২১-২৮ হাজার কেজি চিকিৎসা-বর্জ্য জমা হয়।

    অথচ হাজার দুয়েকের কিছু বেশি বেডের আরজি করে সেই বর্জ্যের পরিমাণ দাঁড়ায় মাসে ৭-১০ হাজার কেজি মাত্র। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৩ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে এনআরএসে মোট জমা হওয়া চিকিৎসা-বর্জ্যের মোট পরিমাণ ছিল ১ লক্ষ ৫৩ হাজার ৬৫০ কেজি। সেখানে ওই সময়কালে মোট ৪৯ হাজার ৬০২ কেজি বর্জ্যই জমা হয়েছিল আরজি করে।

    প্রশ্ন উঠেছে, ছ’ মাসে এই প্রায় ১ লক্ষ কেজি-র বেশি চিকিৎসা-বর্জ্য কোথায় গেল? তদন্তে নেমে সিবিআইয়ের সন্দেহ, হাসপাতালের শীর্ষস্থানীয় কর্তার সঙ্গে জনৈক শঙ্কর রাউত, মহম্মদ আফজল এবং সিবিআইয়ের হাতে ধৃত আফসার আলি খানের যোগসাজসে ওই বিপুল পরিমাণ চিকিৎসা-বর্জ্য সরকারি বিধিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পাচার হয়ে যেত বাইরে।

    নেপথ্যে প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের মদতের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না তদন্তকারীরা। কারণ, ওই বর্জ্যের অন্তত ৭০ শতাংশই স্যালাইনের বোতল, সিরিঞ্জ, গ্লাভস, টুর্নিকেট ইত্যাদির মতো প্লাস্টিকজাত এমন বর্জ্য যেগুলি ‘রিসাইকল’ বা প্রক্রিয়াকরণের পরে আবার ব্যবহারযোগ্য উপকরণ দিয়ে তৈরি। আর সেগুলো পাচার করেই লক্ষ লক্ষ টাকার বেআইনি ব্যবসা চলতো আরজি করে।

    কী করা হতো পাচার হয়ে যাওয়া সেই বর্জ্য নিয়ে?

    সন্দেহ, আফসারের নেতৃত্বে শঙ্কর ও আফজল সেই বর্জ্য পাচার করে দিত সিঙ্গুর, তিলজলা ও চৌবাগার কয়েকটি জায়গায়। সেখানে কিছু সিরিঞ্জ ও বোতল সাফাই করে নতুন প্যাকেটে ভরে ফের বাজারজাত করা হতো, যার একটা বড় অংশই পাচার হয়ে যেত বাংলাদেশে। আর বাকি প্লাস্টিক গলিয়ে দানা বা গ্র্যানিউল বানানো হতো নানা জিনিস তৈরিতে। সেই গ্র্যানিউলের দাম বাজারমূল্যের চেয়ে যেহেতু কম পড়তো, তাই ছোটখাটো বেশ কিছু প্লাস্টিকের খেলনা ও থালা-বাটি-চামচ প্রস্তুতকারক কারখানাও সেগুলি কিনে নিত।

    এমন পাচার চক্রের জেরেই সাধারণ মানুষ না-জেনেই বিপদে পড়তে পারেন বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ হিসেবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘চিকিৎসা-বর্জ্যের যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি থাকে সংক্রমণের। বিশেষ করে এইচআইভি, হেপাটাইটিস-বি এবং হেপাটাইটিস-সি সংক্রমণের।’ মাইক্রোবায়োলজির শিক্ষক-চিকিৎসক সৌগত ঘোষ জানান, খুব সামান্য হলেও ম্যালেরিয়ার মতো সংক্রমণও দানা বাঁধতে পারে।

    তাই চিকিৎসা-বর্জ্যের যথাযথ ব্যবস্থাপনা বা বায়োমেডিক্যাল ওয়েস্টে ম্যানেজমেন্ট হাসপাতাল প্রশাসন চালানোর ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের আধিকারিকরা। কিন্তু আরজি করে নিয়মমতো ব্যবহার করা হতো না দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ নির্ধারিত হলুদ, নীল, লাল ও কালো প্যাকেট। হলুদ প্যাকেটে রক্ত, ব্যবহৃত গজ-তুলো, ডেলিভারির পরে প্রসূতির শরীর থেকে সংগৃহীত প্লাসেন্টা-সহ মানব-শরীরের দেহরস কিংবা ফেলে দেওয়া অঙ্গ ইত্যাদি রাখার কথা। প্লাস্টিকের যাবতীয় জিনিস ফেলার কথা লাল প্যাকেটে। ব্যবহৃত সিরিঞ্জ, স্লাইড, কাচের টুকরো ইত্যাদি শার্প অবজেক্ট রাখার কথা নীল প্যাকেটে। আর সাধারণ পুরবর্জ্য ফেলার কথা কালো প্যাকেটে।

    অথচ সিবিআইয়ের সন্দেহ, প্রথম তিনটি রঙের প্যাকেটে চিকিৎসা-বর্জ্য থাকার কথা থাকলেও নজরদারি এড়িয়ে তা ফেলা হতো পুরসভার ভ্যাটে অথবা কালো প্যাকেটে। যদিও তা যথাযথ না-হওয়ায় কিছু বেসরকারি সংস্থা প্লাসেন্টাগুলি কিনে নিত ব্যবসায়িক মডেলে স্টেম সেল সংরক্ষণের কাজে।

    ফলে সরকার নির্ধারিত যে বেসরকারি বহুজাতিক সংস্থা হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা-বর্জ্য সংগ্রহ করে, তা হলদিয়া, কল্যাণী ও উলুবেড়িয়ার প্লান্টে নিয়ে গিয়ে নষ্ট করে ফেলার কথা, সেই সংস্থা প্রত্যাশিত পরিমাণের বর্জ্যই পেত না আরজি কর থেকে। তদন্তকারীরা এখন বুঝতে পারছেন, সেই বর্জ্য কোথায় কী ভাবে পাচার হয়ে যেত, ঠিক কার কার মাধ্যমে।
  • Link to this news (এই সময়)