প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে... শোনা যায়, ১৮৮৮ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দার্জিলিংয়ে বসে লিখেছিলেন প্রবাদে পরিণত হওয়া এই লাইনটি।
১৩৬ বছর পর, দার্জিলিং থেকে প্রায় ৫৪০ কিলোমিটার দূরে নদিয়ার হাঁসখালিতে এই লাইনটি তো বটেই, তার পরের লাইনটিও এ ভাবে মিলে যাবে, কবি কি জানতেন? ‘কে কোথা ধরা পড়ে, কে জানে।’প্রেমের ফাঁদ তো পাতাই, সঙ্গে দুশমনিরও! বেশ ‘হোমরা-চোমরা’ মক্কেলের স্ত্রীর প্রতি নিজের অনুরাগ কিছুতেই লুকোতে পারেননি উকিলবাবু। মক্কেল তখন জেলে। সেই সুবাদে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে নিত্য যোগাযোগ, চোখে-চোখে ইশারা। মজে যায় যুবতীর মনও। অভিযোগ, জেল খেটে বেরিয়ে দিন কয়েকের মধ্যে তাঁর পিঠ-পিছে এই প্রেমের ছবি স্পষ্ট হয় মক্কেলের কাছে।
পরিণতিতে স্ত্রীকে খুনই করে ফেলেন তিনি। আর সেই প্রেমের জেরে শুরু হয় উকিল-মক্কেলের ডুয়েল! ২০১৫ থেকে ২০২৪ — অদ্যাবধি তা চলছে। দু’জন দু’জনের ‘জান কি দুশমন’ হয়ে বসে আছেন। একাধিক বার খুনোখুনির চেষ্টা চালিয়েছে দু’পক্ষই। সেই সিলসিলার শেষতম গ্রেপ্তারি হলো মঙ্গলবার গভীর রাতে। এ যাত্রায় পুলিশের হাতে মক্কেল।
টানটান এই ফিল্মি প্লটের ঘটনাস্থল নদিয়ার হাঁসখালি থানার বগুলা। সেখানকার দুষ্কৃতী আশিস মণ্ডলের গ্রেপ্তারি দিয়ে এই ঘটনাক্রমের সূত্রপাত। ছোট-মাঝারি নানা কুকর্মে আশিসের বেশ নাম-ডাক হয়েছিল এলাকায়। হাত পাকিয়েছিলেন মাদকপাচারেও। যেতে হয় জেলে। তাঁর স্ত্রীর যোগাযোগ হয় রানাঘাট কোর্টের আইনজীবী প্রসেনজিৎ দেবশর্মার সঙ্গে।
এমন বিপদের দিনে উকিলের থেকে বড় বন্ধু আর কে-ই বা আছেন! সুখ-দুঃখের দু’টি কথা কইতে কইতে আশিসের স্ত্রীর সঙ্গে কখন যে মন দেওয়া-নেওয়া হয়ে গিয়েছে, তা বুঝতেই পারেননি প্রসেনজিৎ। দু’জনে যখন প্রেমের পিঞ্জরে খুনসুটিতে ব্যস্ত, সেই ২০১৫ সালে আশিস একদিন লোহার পিঞ্জর থেকে মুক্তি পান। বাড়ি ফেরার ক’দিনের মধ্যেই টের পান, তাঁর প্রেম-পিঞ্জর ভেঙে মনে-মনে ফুড়ুৎ স্ত্রী। ব্যস! অভিযোগ, রাগের মাথায় বউকেই খুন করে বসেন আশিস। অতঃপর ফের জেল-যাত্রা।
এর পর কেটে যায় দুটো বছর। ২০১৭ সালে জামিনে ছাড়া পান আশিস। বলাই বাহুল্য, তাঁর হয়ে আদালতে প্রসেনজিৎ দাঁড়াননি। সংশোধনাগারে দু’বছর থাকার পরেও অবশ্য আশিসের রাগ তো পড়েইনি, বরং প্রতিশোধের আগুন দিনে দিনে বেড়েছিল। জামিনে বেরিয়ে প্রসেনজিতের উপরে একাধিক বার হামলা চালান তিনি। কিন্তু কোনও বার আশিসের ভুল প্ল্যান, কোনও বার ভাগ্য প্রসেনজিৎকে বাঁচিয়ে দেয়। এক সময়ে প্রসেনজিৎও ভাবেন, এই শত্রুকে জব্দ করতেই হবে।
অভিযোগ, তিনিও দলবল জোগাড় করে হাঁসখালিতে আশিসের গ্রামে চড়াও হন। তত দিনে এই দু’জনের দুশমনির খবর ছড়িয়ে পড়েছে এলাকায়। একসময়ে অবস্থা এমন হয় যে, দু’পক্ষই তটস্থ থাকতেন এই বুঝি হামলা হলো। সে কথা পুলিশেরও অজানা ছিল না। তাই পুলিশও দু’জনকে চোখে চোখে রাখত। প্রসেনজিৎ সদলবলে আশিসের গ্রামে ঢুকতেই খবর পেয়ে যায় পুলিশ। যথাসময়ে গ্রামে অবতীর্ণ হয়ে তারা পাকড়াও করে প্রসেনজিৎকে। পরে জামিনে মুক্ত হন তিনিও। আশিসের সঙ্গে ডুয়েলে কার্যত নিজের পেশাও ভুলতে বসেন প্রসেনজিৎ।
ওদিকে আবার তার মধ্যেই মাদক পাচার করতে গিয়ে ফের ধরা পড়েন আশিস। ২০১৮-২০২২, চারটি বছর জেল খেটে ফের গ্রামে আসেন। প্রতিশোধের আঁচ তখনও ঢিমে হয়নি তার। তার পর ফের হামলার প্ল্যান, ফেল, ফের জেল, জামিন এবং বেরিয়ে আবার হামলার জোগাড়। প্রসেনজিৎও হাত গুটিয়ে বসে ছিলেন না।
এ বছরের ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে হাঁসখালি থানার মিলননগরে এক রাউন্ড গুলি চলার খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে জানতে পারে, আশিসকে খতম করতে দলবল নিয়ে ফের চড়াও হয়েছিলেন প্রসেনজিৎ। উদ্ধার হয় দু’টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং দশ রাউন্ড গুলি। গ্রেপ্তার করা হয় প্রসেনজিৎ ও তাঁর কয়েকজন সঙ্গীকে। কয়েকদিনেই জামিন পেয়ে যান সকলে।
এ বার পালা আশিসের। শত্রুকে কায়দা করতে আগ্নেয়াস্ত্র জোগাড় করছিলেন তিনি। কিন্তু সে সব সমেতই ধরা পড়ে যান মে মাসে। আবার জেল-জামিনের পালা। এবং ছাড়া পেয়েই আবার প্রস্তুতি। এবং সেটা করতে গিয়েই মঙ্গলবার রাতে ফের পুলিশের জালে।
রানাঘাট পুলিশ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার লাল্টু হালদার বুধবার বলেন, ‘আশিস হ্যাবিচুয়াল অফেন্ডার। এ বার ওকে শক্ত ধারা দিয়ে কী ভাবে আটকে রাখা যায় আমরা দেখছি।’ রানাঘাট বার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক মৃণ্ময় চক্রবর্তী বলেন, ‘ওই আইনজীবীর আশঙ্কা, তাঁর উপরে আবার হামলা চালানো হতে পারে। পুলিশ সব দিক দেখে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিক।’