• সচেতনতা থেকে সংবিধান, মানুষের ভাবনাই পুজোর উপাদান ভবতোষের
    বর্তমান | ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • সৌম্য নিয়োগী, কলকাতা: পাশের পিচ রাস্তায় ইতস্তত চার-ছ’টা শিউলি। মাথার উপরে তুলো মেঘ। সল্টলেক ‘এ কে’ ব্লকের সবুজ মাঠ। ঘাসের গা থেকে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো এখনও শুষে নিতে পারেনি ভাদ্র শেষের চড়া রোদ। মণ্ডপে মাটি লেপা প্রায় শেষ ভবতোষ সুতারের। গর্ভগৃহ সম সেই মাটির ঘরে-বাইরে শোনা যাবে বৃষ্টির গান। সে গান শুরু হলে মুহূর্তে ঢেকে যাবে আকাশ। পিছনে কলকাতা শহরের প্রতীক, সামান্য হেলিয়ে রাখা এক সরা। সামনে বিপন্ন বসুন্ধরার গর্ভে লবণ জলের জোয়ার-ভাটা ঘূর্ণির মুখোমুখি বসে এক কিশোরী... আশার আলো পরশপাথরের খোঁজে, সচেতন এক পৃথিবীর প্রার্থনায়।

    এবারের দু-দু’টি চমক নিয়ে হাজির হচ্ছেন শারদোৎসবের অন্যতম সেরা শিল্পী ভবতোষ। বরাবরই তিনি আনন্দের আড়ালে উস্কে দিতে চান সাধারণ মানুষের চিন্তাভাবনাকে। সল্টলেক ‘এ কে’ ব্লক অ্যাসোসিয়েশনের পুজোতেও তার অন্যথা হচ্ছে না। বৃষ্টির জল সংরক্ষণের বার্তা দিচ্ছে তাঁর থিম, ‘বারি বিন্দু’। ‘এ কে’ ব্লক থেকে আধঘণ্টার রাস্তা বাগুইআটির অর্জুনপুর আমরা সবাই ক্লাব। শিল্পীর আস্তিনের তাস। ব্যক্তিগত এক্সপেরিমেন্টের জায়গা। সেখানে ২৫ ফুটের সুবিশাল সংবিধান বানাচ্ছেন তিনি। তার পরতে পরতে গুরুত্বপূর্ণ এক রাজনৈতিক বার্তা, সমাজজুড়ে চলা যাবতীয় বৈষম্যের প্রতিবাদ! সচেতনতা হোক বা সংবিধান, এক অদ্ভুত মিল রয়েছে ভবতোষের সৃষ্টিতে। সবটাই সাদা-কালোয়।

    ভবতোষ অবশ্য স্বীকার করছেন, ভূগর্ভের জলসঙ্কট নিয়ে তাঁর চোখ খুলে দিয়েছেন পরিবেশ বিজ্ঞানী সুজীব করই। সল্টলেকে সেই বার্তা ছড়িয়ে দিতে চান। তিন মহলা মণ্ডপ। জলাভূমির উপরেই গড়ে ওঠা উপনগরীর ইতিহাসের সাক্ষী প্রথম মহল। তারপর সাদা সুবিশাল চার দেওয়াল। সরু লাঠির ডগায় চারকোল বেঁধে সেই দেওয়ালে বৃষ্টিভেজা ছোটবেলার চেনা দৃশ্যগুলি একমনে স্কেচ করে চলেছেন শিল্পী কৃষ্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়। মাঝের চৌবাচ্চায় রাখা থাকবে বালতি-ঘটি। সেসবের উপর ফোঁটা ফোঁটা হয়ে ঝরবে জলতরঙ্গ-সঙ্গীত। অন্দর মহলে সেই গর্ভগৃহ। সামনে মাটির বিশাল সেই কিশোরী প্রতিমা, মাথায় ফিতে-বিনুনি। উল্টোদিকে বসে সহশিল্পীদের কাজ তদারক করছিলেন ভবতোষ। অবিন্যস্ত কাঁচাপাকা দাড়ি। হাতে লেজার টর্চ। সামনে ছোট একটি চৌবাচ্চার মধ্যে দেওয়ালে মাটি দিয়ে দেবী দুর্গার অবয়ব বের করে আনছেন এক সহশিল্পী। দু’পাশ দিয়ে পিলারের মতো ওঠা অংশে বাংলা-হিন্দি-ইংরাজিতে লেখা, ‘বিপন্ন আজ বসুন্ধরা গর্জে ওঠে সিন্ধু, আশার আলো পরশপাথর একটি বারি বিন্দু’। 

    অর্জুনপুর আমরা সবাই ক্লাবেও মণ্ডপে বিশাল সংবিধানের পাতায় থাকবে ১৩ ও ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদ। সাম্যের অধিকারের স্বীকৃতি। ভিতরে ১২৫ ফুটের একটি বিশাল চিত্রকর্ম, যা আঁকছেন শিল্পী সম্বরণ দাস। সংবিধানের পাতার মধ্যে থেকে চিৎকার করে বৈষম্যের প্রতিবাদ জানানো হবে। থাকবে নাট্যকর্মীদের একটি বিশেষ পারফরম্যান্স। 

    জনপ্রিয়তার সঙ্গে শিল্পের আশ্চর্য মিশেল লুকিয়ে থাকে ভবতোষের কাজে। সেটাই শারদ সম্মানগুলিতে সেরার শিরোপা এনে দেয় প্রায় ফি বছর। কিন্তু স্কেল মাপা সৌন্দর্য শিল্পীর পছন্দ নয়। এবারও তাঁর প্রতিমা তথাকথিত সুন্দর নয়। অর্জুনপুরে অগণিত মোষের মৃতদেহের উপর দাঁড়িয়ে থাকবেন দেবী দুর্গা। কালো করাল তাঁর রূপ। অসুরের সারা গায়ে বিভিন্ন লেখা। সেই বিবরণ দিতে দিতেই শিল্পীর বলিষ্ঠ কণ্ঠ... ‘কাজই আমার প্রতিবাদ। আমি তো উদ্বাস্তু। অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছি। জীবনই আমার শিক্ষক। আমি কীভাবে প্রতিবাদ করব, তা তো অন্য কেউ বলে দিতে পারে না!’
  • Link to this news (বর্তমান)