এই সময়: লাইভ স্ট্রিমিং। এই একটি শর্তের জটেই বৃহস্পতিবার আটকে গেল আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৈঠক। আন্দোলনকারীরা নাছোড়, বৈঠকের লাইভ স্ট্রিমিং চাই-ই। আর সরকারের বক্তব্য, পুরো বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন বলে এই বৈঠকের লাইভ স্ট্রিমিং করা যাবে না। তবে স্বচ্ছতার স্বার্থে গোটা পর্বের ভিডিয়োগ্রাফিতে রাজি ছিল সরকার। তারপরেও মন ভেজেনি জুনিয়র ডাক্তারদের।ফলে ঘণ্টা তিনেক অপেক্ষার পর মুখ্যমন্ত্রী এ দিন সন্ধেয় নবান্ন ছাড়েন। আর নবান্নে পৌঁছেও বৈঠক না-করেই ৩২ জন জুনিয়র ডাক্তার ফিরে আসেন স্বাস্থ্য ভবনের সামনে অবস্থান জমায়েতে। ফলে জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতি ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হলেও এ দিন তা ভেস্তে যায়। যদিও এর পরেও যে কোনও শাস্তিমূলক পদক্ষেপ করা হবে না, তাও স্পষ্ট করে দেন মুখ্যমন্ত্রী।
মঙ্গলবার বিকেল ৫টার মধ্যে কর্মবিরতি প্রত্যাহারের ডেডলাইন সুপ্রিম কোর্ট বেঁধে দেওয়ার পর থেকেই শুরু হয়েছিল রাজ্য সরকার ও আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের মধ্যে টানাপড়েন। নানা শর্ত এবং ই-মেল চালাচালির মধ্যে তা আটকে গিয়েছিল। আন্দোলনকারীদের দাবি মেনে কিছুটা নমনীয় হয়ে তাঁদের ন্যূনতম ৩০ জন প্রতিনিধিকে নিয়ে বৈঠকেও সম্মতি দেয় রাজ্য সরকার। বৈঠকে যোগ দিতে বাসে চেপে নবান্নে পৌঁছন আন্দোলনকারীদের ৩২ জন প্রতিনিধি।
জুনিয়র ডাক্তারদের অনেকেই বৈঠকে রাজি ছিলেন। তাঁরা আলোচনায় বসতে চেয়েছিলেন। বাইরে থেকে দু'-একজনের কাছে নির্দেশ এসেছিলমুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
কিন্তু বৈঠকের লাইভ স্ট্রিমিংয়ের দাবিতে তাঁরা অনড় ছিলেন। মুখ্য সচিব মনোজ পন্থ, রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমাররা আন্দোলনকারীদের বারবার বোঝানোর চেষ্টা করলেও বরফ গলেনি। ফলে মঙ্গল ও বুধবারের পরে বৃহস্পতিবারও মুখ্যমন্ত্রী দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করলেও অচলাবস্থা কাটল না। এই পরিস্থিতিতে দৃশ্যতই হতাশ মুখ্যমন্ত্রী বলেন, 'আমি আমার সাধ্যমতো যা করার করলাম। সদিচ্ছা আছে বলেই পরপর তিন দিন আমি ওঁদের জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করেছি। এর পরে ওঁরা আলোচনায় বসতেই পারেন। সে ক্ষেত্রে মুখ্য সচিব এবং অন্য অফিসারেরা আছেন। তাঁদের সঙ্গে নিশ্চয়ই আলোচনায় বসতে পারেন।'
আন্দোলনকারীদের একাংশ যে এ দিন বৈঠকে রাজি ছিলেন, সে খবরও তাঁর কাছে রয়েছে বলে দাবি করেন মমতা। তাঁর কথায়, 'অনেকেই আলোচনায় বসতে চেয়েছিলেন। বাইরে থেকে দু'-একজনের কাছে নির্দেশ এসেছিল। ওঁরা বোধ হয় বিচার চান না, ওঁরা চান চেয়ার।' কারা এই 'নির্দেশ' দিয়েছিল, তা নিয়ে স্পষ্ট করেননি মমতা।
বাইরে থেকে ফোন আসার তত্ত্ব সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। আমরা সকলেই চাই আলোচনা হোক। আশা রাখি, শেষ পর্যন্ত আলোচনা হবেআন্দোলনকারী চিকিৎসক অর্ণব মুখোপাধ্যায়
এরপরেই ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবে তিনি বলেন, 'আমি নিজে পদত্যাগ করতেও রাজি আছি। আমি পদ চাই না। আমি মুখ্যমন্ত্রীর পদ চাই না। আমি তিলোত্তমার বিচার চাই। আমি চাই, মানুষ ভালো থাকুক।' গত ১৩ বছরে তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বের জমানায় মমতা একাধিক বার বলেছেন, তিনি কোনও পদের জন্য লালায়িত নন। মানুষের স্বার্থে পদ ছাড়তে তিনি কুণ্ঠাবোধও করবেন না। তবে এত স্পষ্ট করে 'পদত্যাগ'-এর কথা সাম্প্রতিক অতীতে তাঁর মুখে শোনা যায়নি।
বিরোধীরা, বিশেষ করে বিজেপি আরজি করের ঘটনার পরে 'দফা এক, দাবি এক, মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ' স্লোগান তুলে বিক্ষোভ দেখালেও তাকে গুরুত্ব দেননি মমতা। তবে এ দিন তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন, আরজি করের নির্যাতিতা যাতে ন্যায় বিচার পান এবং সাধারণ রোগীদের স্বার্থে যাতে ডাক্তাররা কর্মবিরতি তুলে নেন- সে জন্য প্রয়োজনে পদ ছাড়তেও তিনি দ্বিধাবোধ করবেন না। মুখ্যমন্ত্রীর বিশ্বাস, এ দিন কিছু 'বহিরাগত'র প্রভাবেই ভেস্তে গিয়েছে বৈঠক। আন্দোলনকারীরা অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীর এই অভিযোগ নস্যাৎ করেন।
মঙ্গলবার থেকে যখন বৈঠকের তোড়জোড় চলছিল, তখন প্রথমে নবান্নে ১০ জন প্রতিনিধিকে যেতে বলা হয়েছিল সরকারের তরফে। পরে আন্দোলনকারীদের দাবিতে কিছুটা নমনীয় হয়ে সংখ্যাটা ১৫ জন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। কিন্তু আন্দোলনকারীরা ন্যূনতম ৩০ জন প্রতিনিধি এবং বৈঠকের লাইভ স্ট্রিমিংয়ের দাবিতেই অনড় থাকেন।
এরই মধ্যে স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে বৃহস্পতিবার সকালে রাজ্যের সব মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষকে চিঠি দিয়ে নির্দেশ দেওয়া হয়, ইতিমধ্যেই কাজে যোগ দিয়েছেন যে সব জুনিয়র ডাক্তার, তাঁদের তালিকা যেন স্বাস্থ্যভবনে পাঠানো হয় দুপুর ২টোর মধ্যে। বোঝা যায়, আন্দোলনকারীদের উপর চাপ বাড়াচ্ছে রাজ্য সরকার।
এ দিন দুপুরে মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ ই-মেল করে জুনিয়র ডক্টর্স ফ্রন্টকে তৃতীয় বারের জন্য বৈঠকে ডাকেন নবান্নে। চিঠিতে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, লাইভ স্ট্রিমিং করা যাবে না, তবে গোটা পর্বের ভিডিয়ো রেকর্ডিং করা হবে। মুখ্যসচিব মনে করিয়ে দেন, সুনাগরিক হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশকে সম্মান জানিয়ে জুনিয়র ডাক্তারদের কাজে যোগ দেওয়া উচিত। এ দিন বিকেল ৫টায় বৈঠকে ডাকা হয় চিকিৎসকদের। তার জন্য ৪.৪৫ নাগাদ নবান্নে পৌঁছে যাওয়ার কথা বলা হয় ডাক্তারদের।
আন্দোলনকারীরা জবাবি মেলে জানান, তাঁরাও কাজে যোগ দিতে চান। তাই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে খোলা মনের আলোচনায় তাঁরাও আগ্রহী। সে জন্যই তাঁরা অন্তত ৩০ জন প্রতিনিধিকে নিয়েই নবান্নে যাচ্ছেন। সংশয় দেখা দেয়, নবান্নে আদৌ ১৫ জনের বেশি প্রতিনিধি ঢোকার অনুমতি পাবেন কি না। যদিও সেই সংশয়ের অবসান হতে দেরি হয়নি। বিকেল ৫.২৫ নাগাদ নবান্নে পৌঁছনোর পর জুনিয়র ডাক্তারদের ৩২ জনের প্রতিনিধি দলকেই ভিতরে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয়। তাঁদের নাম লিখে, মোবাইল জমা নিয়ে একে একে নবান্ন সভাঘরের দিকে এগিয়ে দেয় পুলিশ।
কিন্তু সরকার লাইভ স্ট্রিমিংয়ে 'না' করে দিচ্ছে, এমন বার্তা চাউর হয়ে যেতেই বেঁকে বসেন আন্দোলনকারীরা। তাঁদের বোঝাতে বাইরে বেরিয়ে আসেন মুখ্যসচিবের পাশাপাশি ডিজিপি রাজীব কুমার ও রাজ্য পুলিশের এডিজি (দক্ষিণবঙ্গ) সুপ্রতীম সরকার। কিন্তু ঘণ্টা দুয়েকের বেশি কেটে যাওয়ার পরও সরকারের শর্তে রাজি হননি জুনিয়র ডাক্তাররা। নবান্ন সভাঘরে ঠায় বসে থাকার পর সাংবাদিক বৈঠক করে মুখ্যমন্ত্রী নবান্ন ছাড়েন সন্ধ্যা ৭.৩০ নাগাদ।
সাংবাদিক বৈঠকে মমতা বলেন, 'ওঁরা দেরি করেছিলেন। আমরা মাইন্ড করিনি। আমি আজকে প্রেসকে বলতাম, আমরা শোক প্রস্তাব নিতাম তিলোত্তমার জন্য। প্রয়াত সীতারাম ইয়েচুরির জন্যও নীরবতা পালন করতাম। আমি জানি, নির্যাতিতা বিচার পাক, তার পরিবার বিচার পাক- রাজ্যের সবাই তা-ই চাইছে। আমি নিজেও হেঁটেছিলাম (এই দাবিতে)। সিবিআই তাড়াতাড়ি বিচার করুক। ওরা তদন্ত করছে। মনে রাখবেন, আজকে আমাদের আলোচনাটা ছিল পরিকাঠামো, সুরক্ষা ইত্যাদি নিয়ে। টেলিকাস্টের ব্যাপারে আমরা ওপেন মাইন্ডেড। কিন্তু কিছু নিয়ম মানতে হয় বিচারাধীন বিষয়ে।' তিনি জানান, আন্দোলনকারীদের মনোভাবের কথা মাথায় রেখেই স্বাস্থ্য দপ্তরের কোনও কর্তাকে তিনি বৈঠকে রাখেননি।
মমতার অনুযোগ, 'ডাক্তার ভাইবোনেরা এসেছেন এখানে। অপেক্ষা করছিলাম, ওঁদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। আমরা ই-মেল করেছিলাম। ওঁরা আসবেন বলে জানিয়েছিলেন। আমরা বলেছিলাম, খোলা মনে আসুন। যেটা চান, আলোচনা করুন। আপনাদেরও বাঁধন নেই, আমাদেরও নেই। হয়তো পাঁচটা নতুন কথাও আসতে পারে। কথা বললেই সমাধান হয়।' কিন্তু তাতেও শুধুমাত্র লাইভ স্ট্রিমিংয়ের প্রশ্নে বৈঠক ভেস্তে যাওয়ায় হতাশা লোকাননি মুখ্যমন্ত্রী।
তাঁর যুক্তি, '২০১৭-তে যে বার লাইভ স্ট্রিমিং হয়েছিল (এনআরএসে জুনিয়র ডাক্তার প্রহৃত হওয়ার পরে শুরু হওয়া কর্মবিরতি), ঠিকই বলেছে, সে বার কেসটা সিবিআইয়ের কাছে ছিল না, সুপ্রিম কোর্টেও ছিল না। এ বার পরিস্থিতি আলাদা। তাই ভিডিয়োগ্রাফির ব্যবস্থা করেছিলাম, তিনটে ক্যামেরা দিয়ে। ওঁরা চাইলে সুপ্রিম কোর্টের অনুমতি নিয়ে ওঁদের শেয়ারও করতে পারতাম। সুপ্রিম কোর্ট লাইভ স্ট্রিমিং করতে চাইলেও আমরা পারি না। একটা বিচারাধীন কেসের এ ভাবে লাইভ স্ট্রিমিং হতে পারে না।'
যদিও বৈঠক ভেস্তে যাওয়ার পরে নবান্নের সামনে দাঁড়িয়েই জুনিয়র ডাক্তারদের তরফে অর্ণব মুখোপাধ্যায়, আসফাকউল্লা নাইয়ারা বলেন, 'আমরা ওঁর (মুখ্যমন্ত্রী) চেয়ার চাইতে আসিনি। ওঁর পদত্যাগও চাইনি। ওই চেয়ারটাকে ভরসা করেই এসেছিলাম। তবে আমাদের সামনে যখন নবান্নের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল, তখন বুঝলাম আলোচনার আশা আজ আর নেই। তবে আমাদের বিশ্বাস, ওই দরজা একদিন খুলবে। আমাদের তরফে আলোচনার রাস্তা খোলাই রইল।'
লাইভ-জট
* জুনিয়র ডাক্তারদের দাবি: বৈঠকের লাইভ স্ট্রিমিং করতে হবে
* তাঁদের যুক্তি: স্বচ্ছতার স্বার্থে সরকারের সঙ্গে বৈঠকের লাইভ সাক্ষী থাকুক রাজ্যবাসী
* সরকারের অবস্থান: লাইভ স্ট্রিমিং নয়, তবে বৈঠকের ভিডিয়ো রেকর্ডিং হবে
* তাদের যুক্তি: পুরো বিষয়টি সু্প্রিম কোর্টে বিচারাধীন, মামলার তদন্ত করছে সিবিআই। তাই এমন সংবেদনশীল ব্যাপার নিয়ে আলাপ-আলোচনা লাইভ স্ট্রিমিংয়ে চলতে পারে না