বেড তো নয় কুমিরছানা! স্ক্র্যাপের নামে দুর্নীতি বহু কোটির
এই সময় | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪
সুনন্দ ঘোষ
বোতাম টিপে হাসপাতালের বেড ওঠানো-নামানো যায়। আধুনিক এই বেড থাকে বেসরকারি হাসপাতালে। গত কয়েক বছরে সেই ধরনের রিমোট কন্ট্রোল বেড সরকারি হাসপাতালে, মূলত ট্রমা সেন্টার, আইসিইউ, এইচডিইউ-তেও কম-বেশি চালু হয়েছে।এই এক-একটি আধুনিক বেডের দাম দেড় লক্ষ টাকার কাছাকাছি। কম দামিও রয়েছে। সেটা বেডের প্রযুক্তি ও গুণগত মানের উপর নির্ভর করে। আরজি কর হাসপাতালে এই আধুনিক বেড ঘিরে যে দুর্নীতি হয়েছে, তা খতিয়ে দেখে বেশ অবাক সিবিআই। ওই হাসপাতালের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে হেফাজতে নিয়ে এবং হাসপাতালের নথি ঘেঁটে দুর্নীতির বিভিন্ন আঙ্গিক খুঁজে পাচ্ছেন তদন্তকারীরা।
তাঁদের দাবি, এখনও পর্যন্ত যতটুকু জানা গিয়েছে, তা গোটা দুর্নীতির মাত্র ১০ শতাংশ। হাসপাতাল বর্জ্য বাইরে বিক্রি করে দেওয়া বা হাসপাতালের ভিতরে বিনা টেন্ডারে রেস্তোরাঁর বরাত দেওয়া-সহ বেশকিছু দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত শুরু করেছে সিবিআই। তাদের দাবি, এর বাইরেও রয়েছে দুর্নীতির আরও বহু দিক।
সূত্রের খবর, আরজি করে এই দামি বেডগুলির একটি হ্যান্ডল খারাপ হলে বা কোথাও রং চটে গেলে সেগুলি বাতিল বা স্ক্র্যাপ বলে খাতায়-কলমে দেখিয়ে দেওয়া হতো। দেখানো হতো, তার জায়গায় কেনা হচ্ছে নতুন বেড। বাস্তবে ঘটত অন্য রকম। যে অংশটুকু খারাপ হতো বা রঙ চটে যেত, সেগুলো সারিয়ে, রং করে আবার ফিরিয়ে আনা হতো হাসপাতালে। তার পিছনে খরচ পড়ত পাঁচ-দশ হাজার টাকা। আর বিল হতো নতুন বেড-এর। যার অর্থ, দশ হাজার খরচ হলে দেখানো হতো প্রায় দেড় লক্ষ টাকা। বলাই বাহুল্য সেই টাকা চলে যেত প্রভাবশালীদের পকেটে। যে তালিকার উপরের দিকে সন্দীপের নাম রয়েছে বলে দাবি সিবিআইয়ের।
তদন্তকারীদের সূত্রে জানা গিয়েছে, এই বেনিয়ম ধরা পড়ে স্ক্র্যাপের হিসেব দেখতে গিয়ে। কারণ, যে বেডটি স্ক্র্যাপের তালিকায় চলে যেত, পরে সেটি তো স্ক্র্যাপ হিসেবে বিক্রি হওয়ারও কথা। বিক্রির সেই টাকা ঢোকার কথা সরকারি কোষাগারে। কিন্তু, তদন্তে নেমে সিবিআই দেখতে পেয়েছে, যে বেড স্ক্র্যাপ বলে দেগে দেওয়া হয়, সেগুলি আর স্ক্র্যাপ হিসেবে বিক্রিই হয়নি। তা হলে কোথায় গেল সেই বেডগুলি? তখনই বেরিয়ে আসে এই তথ্য।
জানা যায়, খাতায়-কলমে স্ক্র্যাপ বলে দেখানো হলেও আদতে সেগুলিই সারাই করে ব্যবহার করা হচ্ছে। তদন্তকারীদের দাবি, কুমিরছানার মতো একই বেড বার বার করে স্ক্র্যাপ দেখিয়ে তার জায়গায় খাতায়-কলমে নতুন বেড কিনে সেই টাকার পুরোটাই পকেটস্থ করা হয়েছে।
এ ভাবে আধুনিক বেড সংক্রান্ত দুর্নীতিতে হাসপাতালের সঙ্গে যোগসাজশে উঠে এসেছে একটি বেসরকারি সংস্থার নামেও। সেই নামটি এখনও জনমানসে উঠে আসেনি। তদন্তকারীদের দাবি, উল্টোডাঙার কাছাকাছি এই সংস্থা থেকেই মূলত আধুনিক বেড সারিয়ে তাদের কাছ থেকে নতুন বেড-এর বিল নেওয়া হতো। দশ বছর আগে তৈরি হয় এই সংস্থাটি।
কোম্পানি-তথ্য অনুযায়ী, এরা ফেস মাস্ক, হাসপাতাল বেড-ট্রলি-টেবল তৈরি করে বিক্রি করে। এক বাঙালি ব্যক্তি তার মালিক। সিবিআইয়ের তদন্তের আওতায় এসেছে এই সংস্থা। সিবিআইয়ের দাবি, এই দুর্নীতি যে শুধু আরজি কর হাসপাতাল জুড়ে ছিল তা নয়। রাজ্যের সমস্ত সরকারি হাসপাতালেই চলছে আর্থিক দুর্নীতির চক্র। যেখানে কোটি কোটি টাকার বেআইনি লেনদেন হচ্ছে।
তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, এই সীমাহীন দুর্নীতি করতে করতে মূল বা বেসিক কিছু জায়গায় বড় ধরনের গন্ডগোল করে রেখেছিল দুর্নীতিবাজরা। উদাহরণ হিসেবে উঠে এসেছে হাসপাতালের জন্য রেফ্রিজারেটর কেনার বিষয়টিও। তদন্তকারীদের দাবি, ওষুধের দোকান, যারা ফ্রিজ বিক্রি করতেই পারে না, তাদের থেকে যেমন ফ্রিজ কেনা হয়েছে, তেমনই দুর্নীতির সময়ে খেয়াল করা হয়নি যে এই ফ্রিজগুলি মূলত বাড়িতে ব্যবহার করার ফ্রিজ। হাসপাতালে হাই-এন্ড ফ্রিজ ব্যবহার করা হয়। তদন্তকারীদের দাবি, সেখানেও ফেঁসে গিয়েছেন সন্দীপ অ্যান্ড কোম্পানি।