অনুরাগ রায়: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বার বার বলেন, তাঁর জন্ম আন্দোলনের গর্ভে। আন্দোলনের ভাষা তিনি বোঝেন। যেটা বলেন না সেটা হল, আন্দোলনের ঝাঁজ কখন কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় সেটাও তাঁর নখদর্পণে। আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি এবং অভিমুখ কীভাবে ঘুরিয়ে দিতে হয়, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কীভাবে কামব্যাক করতে হয়, দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা সেটা খুব ভালোমতো শিখিয়ে দিয়েছে তাঁকে। সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে অতীতে বহুবার বহু কামব্যাক করেছেন মমতা। যখন বিরোধী নেত্রী ছিলেন তখন তো বটেই, মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসার পরও বহুবার চাপ এসেছে, সেই সব চাপ সামলে স্বমহিমায় প্রত্যাবর্তন করেছেন। ঠিক যেমনটা করলেন শনিবার জুনিয়র চিকিৎসকদের ধরনামঞ্চে যোগ দিয়ে।
পাঁচ দফা দাবি নিয়ে স্বাস্থ্যভবনের সামনে ধরনা-কর্মসূচি চালাচ্ছেন জুনিয়র চিকিৎসকদের একাংশ। সিনিয়র চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ তাঁদের দাবির পক্ষে। শুরুর দিকে বিপুল জনসমর্থনও ছিল আন্দোলনকারীদের পক্ষে। নিন্দুকেরা বলেন, এসবের পাশাপাশি ছিল রাজনৈতিক ইন্ধনও। সব মিলিয়ে সরকারের বিরুদ্ধ স্বর হিসাবে উঠে আসছিল চিকিৎসকদের ধরনামঞ্চ। রাজ্যের ‘নিষ্ক্রিয়’ বিরোধী শিবির যা করতে ব্যর্থ, সেটাই খানিক করে দেখিয়েছেন কয়েক হাজার চিকিৎসক পড়ুয়া। সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করা, আমজনতার সহানুভূতি কুড়নো। বলতে আপত্তি নেই, তাতে খানিক ব্যাকফুটে পড়ে গিয়েছিল সরকার। ব্যাকফুটে পড়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী নিজে।
সরকারের প্রতি আস্থা কমছে মানুষের, বুঝতে দেরি করেননি মমতা। দফায় দফায় আলোচনার টেবিলে ডেকেছেন আন্দোলনকারীদের। তাতে সাড়া মেলেনি। নিজে নবান্নে অপেক্ষা করেছেন। আন্দোলনকারীরা বারবার শর্ত চাপিয়েছেন, জটিলতা তৈরি করেছেন, সুপ্রিম কোর্টের ‘পরামর্শ’ অমান্য করেছেন। কিন্তু এসবের পর শাস্তির বিধান দেওয়ার পথ খোলা থাকলেও সে পথ মাড়ালেন না মমতা, বরং ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করলেন আন্দোলনকারীদের জন্য। নবান্ন সভাঘরে একা পড়ুয়াদের জন্য অপেক্ষায় মুখ্যমন্ত্রী, সেই ছবি আমজনতার মননে কী প্রভাব ফেলতে পারে, সেটা শহুরে মধ্যবিত্তর পক্ষে বোঝা বড় কঠিন।
এর পর মমতা যেটা করলেন, সেটা আক্ষরিক অর্থেই মাস্টারস্ট্রোক। ঝড়জল উপেক্ষা করে সটান চলে গেলেন ধরনামঞ্চে। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একাত্মতার বার্তা দিয়ে বলে গেলেন, “মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে নয়, দিদি হিসাবে তোমাদের কাছে এসেছি। তোমাদের আন্দোলনকে কুর্নিশ। আমি সমব্যাথী।” বড় দিদির মতোই বললেন, “ঝড়জলের রাতে তোমরা এখানে পড়ে ছিলে, আমিও রাত জেগেছি, তোমাদের পাহারাদার হিসাবে।” আন্দোলনকারীদের আশ্বস্ত করে বলে দিলেন, “আমার উপর ভরসা রাখো। কারও প্রতি অন্যায় হতে দেব না। কোনও দোষী আমার বন্ধু নয়। একটু সময় দিতে হবে। একদিনে হবে না।” প্রতিটি কথায়, আস্থা ফিরে পাওয়ার চেষ্টা, প্রতিটা কথায় মমত্ব আর একাত্মতার বার্তা। যা প্রত্যাখ্যান করা আমজনতার পক্ষে কঠিন। ঝড়জলের দিনে আন্দোলনকারীদের পাশে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বসে পড়ার যে ছবি, সেই ছবি মিইয়ে পড়া তৃণমূল সমর্থকদের মধ্যে তাঁর প্রতি আস্থা ফেরাবে শুধু নয়, একই সঙ্গে জনমানসেও বার্তা দেবে, দরকারে মমতার সরকার নমনীয় হতে রাজি। কোথাও ভুল হয়ে থাকলে, সেই ভুল শুধরে নিতে রাজি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আরও একবার রাস্তায় নেমে বোঝালেন, ‘আমি তোমাদেরই লোক। বিপদের দিনে তোমাদের পাশে আছি।’ বলা বাহুল্য, এদিন মুখ্যমন্ত্রীর পদক্ষেপের পর চিকিৎসকদের আন্দোলনের ঝাঁজ কমবে। ঠিক যে সময় চিকিৎসকদের প্রতি মানুষের সমর্থনে ভাঁটা পড়া শুরু হল, তখনই মমতার ধরনা মঞ্চে যাওয়া, চিকিৎসকদের আতান্তরে ফেলবে, তাতেও সংশয় নেই।
তবে এই প্রথম নয়। এর আগে ২০১৯ সালে এনআরএসে জুনিয়র চিকিৎসকদের ধরনা মঞ্চেও একইরকম ভাবে উপস্থিত হন মুখ্যমন্ত্রী। সেবার মমতা ধরনা মঞ্চে যাওয়ার পর অচলাবস্থা কাটে। সাম্প্রতিক অতীতেও একাধিকবার দেখা গিয়েছে, সরকার যখনই চাপে পড়েছে তখনই তিনি রাস্তায় নেমে মুশকিল আসান হয়েছেন। সেটা বীরভূমের বগটুই হোক, এগরার খাদিকুল হোক। মমতা পথে নেমেছেন, অচলাবস্থা কাটিয়ে নিজের সরকারকে প্রত্যাবর্তনের পথে ফিরিয়েছেন।