এই সময়: শ্বাসকষ্ট হওয়ায় অসুস্থ স্ত্রীকে তড়িঘড়ি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে গিয়েছিলেন বসিরহাটের আনোয়ার শেখ। ইমার্জেন্সিতে ঢোকার পরে ডাক্তারবাবুরা মার্জনা চাওয়ার ভঙ্গিতে বলেন, ‘রোগীর যা কন্ডিশন এখনই আইসিইউ-য়ে ঢোকাতে পারলে ভালো হয়। এখানে আইসিইউ-তে কোনও বেড খালি নেই। আপনি বরং অন্য হাসপাতালে খোঁজ করুন।’পেশায় মাছ-ব্যবসায়ী আনোয়ারের কথায়, ‘আইসিইউ-তে বেড খালি নেই শুনে যখন হাসাপাতাল থেকে বেরিয়ে আসছি তখনই এক যুবক এগিয়ে আসেন। গাড়ির ভিতর মুখটা বাড়িয়ে বলেন, হাজার দু’য়েক টাকা খরচ করলে এখানেই বেড পেয়ে যাবেন। আমরা অনেক করে রিকোয়েস্ট করার পর শেষ পর্যন্ত দেড় হাজার টাকায় রফা হয়।’
চিকিৎসকদের একাংশ জানাচ্ছেন, এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কলকাতার প্রায় সব সরকারি মেডিক্যাল কলেজে এ ভাবেই টাকার বিনিময়ে বেড বিক্রি হয়। এর পিছনে বড় সিন্ডিকেট রয়েছে। তারাই হাসপাতালের এক শ্রেণির কর্মীর সঙ্গে যোগসাজশে আগে থেকে বেড দখল করে রাখে। তারাই সবটা কন্ট্রোল করে। তাই দালাল কিংবা নেতা-মন্ত্রীদের না ধরলে বড় বড় হাসপাতালে সহজে বেড পাওয়া যায় না।
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের এক চিকিৎসকের কথায়, ‘সাধারণ মানুষ সব সময়ে নেতা-মন্ত্রীদের কাছে পৌঁছতে পারেন না। তাই তাঁদের দালাল ধরতে হয়। হাসপাতাল থেকে রোগীরা প্রত্যাখ্যাত হলেই পাকড়াও করে দালালরা। বেড পাইয়ে দেওয়ার নাম করে রোগীর পরিবারের কাছ থেকে ইচ্ছে মতো টাকা আদায় করে। সেই টাকার একটা অংশ প্রভাবশালীদের কাছেও পৌঁছয়। হাসপাতালের কোনও কোনও আধিকারিকও হয়তো ভাগ পান।’
প্রতিদিন অজস্র রোগী জেলা হাসপাতাল থেকে রেফার হয়ে কলকাতার বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে আসেন। অনেক সময়েই জানতে পারেন, বেড খালি নেই। তখন আবার অন্য হাসপাতালে ছুটতে হয়। সময়ে চিকিৎসা না পেয়ে অনেক ক্ষেত্রে রোগী মারাও যান। তা নিয়ে হাসপাতাল ভাঙচুর, চিকিৎসক ও নার্সকে মারধরের ঘটনাও ঘটে।
এই সমস্যা মেটাতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে ২০১৯ সালে অনলাইন রেফার সিস্টেম চালু হয়েছিল। জেলার কোনও হাসপাতাল থেকে রোগীকে কলকাতার কোনও মেডিক্যাল কলেজে রেফার করার আগে সেখানে আদৌ বেড খালি আছে কিনা, সেই খবরটা যাতে আগাম জানা থাকে, সে জন্যেই এই সিস্টেম চালুর উদ্যোগ হয়েছিল। তাতে কোন হাসপাতাল থেকে কখন কোন রোগীকে রেফার করা হচ্ছে, সেই তথ্য সংশ্লিষ্ট মেডিক্যাল কলেজের অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারদের মোবাইলে এসএমএস করে জানিয়ে দেওয়া হতো।
জেলা হাসপাতালগুলির সঙ্গে কলকাতার মেডিক্যাল কলেজগুলির সমন্বয় রক্ষায় অভিন্ন মোবাইল নম্বরও চালু করা হয়েছিল। স্বাস্থ্য দপ্তরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘করোনার সময়ে অনলাইন সিস্টেমের সুফল মিলেছিল। করোনা আক্রান্তদের ভর্তি করার ক্ষেত্রে খুবই সুবিধা হয়েছিল। কিন্তু করোনা বিদায় নেওয়ার পর কোনও অজানা কারণে সেই সিস্টেম কার্যত উঠে গিয়েছে। যে সংস্থাকে অনলাইন সিস্টেম চালানোর বরাত দেওয়া হয়েছিল, তারা টাকা না পেয়ে মাঝপথে কাজ বন্ধ করে দেয়।’
স্বাস্থ্য দপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, রোগীদের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার রিপোর্ট পেতে যাতে অহেতুক দেরি না হয়, তার জন্যেও কয়েক বছর আগে ঘটা করে অনলাইন সিস্টেম চালু করা হয়েছিল। ঠিক হয়েছিল, রোগীদের কাছ থেকে রক্ত, মল-মূত্রের নমুনা সংগ্রহ করার পরেই রোগী কিংবা তাঁর কোনও পরিজনের মোবাইলে এসএমএস যাবে।
সেই নমুনা ল্যাবরেটরিতে পৌঁছনোর পর নির্দিষ্ট মোবাইল নম্বরে আরও একটা এসএমএস পাঠানো হবে। রিপোর্ট তৈরি হয়ে যাওয়ার পর ওই মোবাইল নম্বরে আবার মেসেজ আসবে। রিপোর্টের হার্ড কপি না এলেও কম্পিউটারে সেটা দেখতে পাবেন চিকিৎসকেরা। হাতেগোনা কয়েকটি মেডিক্যাল কলেজে এই ব্যবস্থা চালু হলেও অধিকাংশ হাসপাতালে এখনও সেটা চালু হয়নি।
ফলে রিপোর্ট পেতেও ঢের সময় লেগে যায়। তার জেরে অনেক সময়ে আটকে যায় জরুরি অপারেশন। চিকিৎসাও শুরু করা যায় না। তখন রোগীরা বাধ্য হন বাইরে যেতে। এর পিছনেও সিন্ডিকেটের হাত রয়েছে বলে মনে করেন অনেকে।
এসএসকেএমের এক প্রবীণ চিকিৎসক বলেন, ‘কলকাতার প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজের নিজস্ব ল্যাব রয়েছে। নয়তো তারা কোনও সংস্থার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। তা সত্ত্বেও সবক’টা মেডিক্যাল কলেজের আশপাশে এত বেসরকারি ল্যাব চলছে কী ভাবে? সরকারি ল্যাব থেকে রিপোর্ট যত দেরি করে আসবে বেসরকারি ল্যাব ততই ফুলে ফেঁপে উঠবে। সে জন্যেই হয়তো অনলাইন ব্যবস্থা চালু করতে দেওয়া হচ্ছে না।’