মাঝে ২৩ দিন। আর তিনটে রবিবার। পুজোর বাজারের সেই চেনা ছবি কোথায়? এই রবিবারে নিউ মার্কেটের ছবিটাই না-হয় ধরা যাক। একদিকে বৃষ্টি আর অন্য দিকে প্রতিবাদ— পুজোর বাজার জমতেই পারল না, অভিমত ব্যবসায়ীদের। সপ্তাহের অন্য দিনেও উপচে পড়া ভিড় নেই। আশা ছিল রবিবারের বাজার নিয়ে। তাতে জল ঢেলেছে নিম্নচাপ। ফুটপাথ থেকে শপিং কমপ্লেক্স, সেই জমাট-বাঁধা ভিড়টা কোথায়?নিউ মার্কেটের গার্মেন্টসের দোকানি মহম্মদ ইরফানের কথায়, ‘এরকম পুজো আমি খুব কম দেখেছি। কোভিডের সময়টা ছিল অন্য। এ বার কেন মানুষ আসছে না, তার সঙ্গে প্রতিবাদের যোগ আছে কি না, বলতে পারব না। তবে বাজারের হাল খুবই খারাপ।’ শ্যামনগর থেকে নিউ মার্কেটে পুজোর বাজারে এসেছেন সমীরণ ও দীপশিখা মণ্ডল। বলছেন, ‘বৃষ্টিটা না থাকলে হয়তো বাজারটা ভরত।’
বিজেপির ধর্নামঞ্চে এসে বাজার সারার ফাঁকে দমদমের দীপক আইচের কথায়, ‘এ বার পুজোয় মন নেই। জাস্টিস পেতেই হবে।’ সল্টলেক সিটি সেন্টারে জামাকাপড়ের দোকানের চেয়ে খাবারের দোকানে ভিড় বেশি। পোশাক বিপণির এক কর্মীর কথায়, ‘রবিবারের বাজারে এক ক্রেতা এসে দুঃস্থদের দিতে কম টাকায় জামাকাপড় কিনে নিয়ে গিয়েছেন।’
একটি বড় দোকানের ক্যাশ কাউন্টারে লেখা — ‘দয়া করে লাইনে দাঁড়ান’। কিন্তু, কোথায় লাইন? পাঁচ তলা দোকানটায় ক’জন খদ্দের ছড়িয়ে রয়েছেন ইতস্তত। অন্য বছরে এই সময়ে গড়িয়াহাটের এই শাড়ির দোকানের ভিড়ের জন্য সামনে দিয়ে যাওয়া যেত না। এ বার না আছে ভিড়, না লাইন! তার উপর রবিবার সকাল থেকেই ঘ্যানঘ্যানে-ঝিরঝিরে বৃষ্টি।
‘চোখ বুজে ভরসা করা যায়’ — এটাই নাকি দক্ষিণাপনের শো-রুমের ক্যাচ-লাইন। সেখানে সারা বছরের ভিড় মাত্রাছাড়া হয় পুজোর সময়ে। এ বার বিরল ব্যতিক্রম। খদ্দেরের অভাবে খাঁ খাঁ করছে গোটা দক্ষিণাপন মার্কেটই। দোকানের কর্মীরা হতাশ মুখে মোবাইল স্ক্রল করে চলেছেন।
লিন্ডসে স্ট্রিটে জনপ্রিয় জুতোর দোকানের মধ্যে ২৫-৩০ জনের ভিড় তো অফ সিজ়নেই দেখা যায়। পুজোর দু’মাস আগে থেকেই ক্যারি ব্যাগে দু’টো-তিনটে করে জুতোর বাক্স নিয়ে লোকজন বেরিয়ে আসছেন, এই চত্বরের নিয়মিত দৃশ্য। এ বার ওই ভিড় যেন মন্ত্রবলে গায়েব! ‘অন্য বছর পুজোর আগে যে ব্যবসা পাই, এ বার তার অন্তত ২৫ শতাংশ ঘাটতি। কবে অবস্থার উন্নতি হবে জানি না’, রীতিমতো হতাশ জামাকাপড়ের একটি বিপণির ম্যানেজিং ডিরেক্টর নিত্যানন্দ আইচ।
বেশ চিন্তিত দেখাল মধ্যপ্রদেশ প্রশাসনের আউটলেট-এর প্রধান কুশলকুমার চট্টোপাধ্যায়কেও। বলছেন, ‘আরজি করের ঘটনা যে ভাবে মহিলাদের নাড়া দিয়েছে, তাতে এ বার পুজোর আগে বাজার ফেরার আশা কম।’ তবে ভিন্ন মতও রয়েছে। পরিস্থিতি ততটাও খারাপ নয়, জানিয়েছেন গড়িয়াহাট মোড়ের বিপণির অভিষেক সাহা। তাঁর কথায়, ‘খদ্দের কিছু কমেছে ঠিকই। কিন্তু ব্যবসা ধসে পড়েছে - এটাও মানছি না। আমাদের পুরোনো কাস্টমার বেসে কোনও হেরফের হয়নি। সামনের কয়েক দিনে ব্যবসা জমে যাবে।’
নিত্যানন্দও স্বীকার করে নিয়েছেন, কলকাতার তুলনায় তাঁদের শহরতলির শো-রুমের অবস্থা কিছুটা ভালো। ওঁদের সদ্য খোলা আসানসোলের শো-রুম এবং চুঁচুড়ার শো-রুমে বিক্রি যথেষ্ট বেশি। কলেজ স্ট্রিটের বিখ্যাত এক দোকানের কর্মী দিব্যেন্দু সাহাও বলেন, ‘আমাদের কাস্টমার বেস কিন্তু পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর এবং বর্ধমান-নির্ভর।’
তবে সামগ্রিক ভাবে ছবিটা সুখের নয়, মানছেন বেশিরভাগ ব্যবসায়ীই। গড়িয়াহাট, হাতিবাগানের ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে গেলে ভেসে আসছে, ‘কী লাগবে বলুন। কথা তো বলুন অন্তত।’ আগের পুজোর মুখে দুপুর থেকে রাত, ভিড় সামলাতে গলদঘর্ম হতেন দোকানদারেরা। এখন সন্ধ্যার হালকা ভিড় ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে রাত আটটায়। দোকানদারদের অভিযোগ, নানা কারণে গত কয়েক বছর ধরেই পুজোর কেনাকাটায় ভাটা। এ বারে তো ‘আরজি কর’ রয়েছে।
হাতিবাগানে একটি নামজাদা জুতোর শো-রুমের কর্মী পথচারীদের ডাকছিলেন, ‘আসুন। দেখে যান। দেখলেই কিনতে হবে এমন কথা নেই।’ দোকানে জনা দুয়েক ক্রেতা জুতো বাছছিলেন। এক কর্মীর কথায়, ‘নিজের চোখেই দেখছেন, কী হাল। আরজি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে রোজ মিটিং, মিছিল, অবরোধ হচ্ছে। মানুষ ভোগান্তির ভয়ে বেরোচ্ছেন না।’
শাড়ির দোকানের মালিক জানালেন, সুদে পাঁচ লাখ টাকা ধার নিয়ে নতুন, নতুন ডিজাইনের শাড়ি এনেছেন। এখনও পঞ্চাশ হাজার টাকার শাড়িও বিক্রি হয়নি। গড়িয়াহাটের ফুটপাথে মোবাইলের বাহারি ব্যাক-কভারের সারি নিয়ে বসে বছর চব্বিশের তরুণী বলেন, ‘সকাল থেকে বসে। সাড়ে তিনটে বাজে। এখনও বউনি হয়নি।’
কসমেটিকসের দোকানের মহিলা কর্মচারী জানালেন, অনলাইনে অর্ডারের উপরে বেঁচে আছেন। লোকে দোকানে কম আসছেন। মিটিং, মিছিল, অবরোধের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে মানুষকে। স্ত্রীর গয়না বন্ধক রেখে তিন লক্ষ টাকায় নতুন ইমিটেশন গয়না এনেছেন দোকানদার। এখনও পর্যন্ত মাত্র ১৮ টাকার বিক্রি হয়েছে। তাঁর কথায়, ‘কী ভাবে কী সামলাবো বুঝে উঠতে পারছি না।’