• পাঁচ ঘণ্টার বৈঠক, মমতা মানলেন অধিকাংশ দাবি, ‘প্রয়োগ’ হলে তবে কাজে ফিরবেন চিকিৎসকেরা
    আনন্দবাজার | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • সরকার পক্ষ জানিয়েছিল, এটাই তাদের পঞ্চম এবং শেষ চেষ্টা। মুখ্যসচিবের সেই ডাকে সাড়া দিয়ে সোমবার আবারও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালীঘাটের বাড়িতে পাঁচ দফা দাবি নিয়ে গিয়েছিলেন আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তাররা। তার পর বসে দু’পক্ষের বৈঠক। এর পর কেটেছে প্রায় ৫ ঘণ্টা— সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১২টা। অবশেষে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি থেকে বেরোলেন জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধি দল। উঠে পড়লেন বাসে। গন্তব্য সল্টলেক। স্বাস্থ্য ভবনের সামনের ধর্নামঞ্চে। যেখানে গত সাত দিন ধরে ধর্না দিচ্ছেন তাঁরা। কী আলোচনা হল? খুশি? জট কাটল? বাসের জানালা দিয়ে এক জুনিয়র ডাক্তারের সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া, ‘‘আলোচনা সদ্‌র্থক। কলকাতা পুলিশ কমিশনারের পদ থেকে বিনীত গোয়েলকে সরানো হচ্ছে।’’ তার কিছু ক্ষণ পরেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মুখোমুখি হলেন সাংবাদিকদের। তিনিও ঘোষণা করলেন, আরজি কর কাণ্ডের প্রেক্ষিতে চিকিৎসকদের দাবি মেনে সিপি-র পদ থেকে মঙ্গলবারই সরানো হচ্ছে বিনীত গোয়েলকে। শুধু তাই নয়, ডাক্তারদের দাবি মেনে নিয়ে স্বাস্থ্য অধিকর্তা এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিকর্তাকেও অপসারণ করা হচ্ছে। তিন জনকেই অন্য পদে দায়িত্ব দেওয়া হবে। মুখ্যমন্ত্রীর সাংবাদিক বৈঠকের মধ্যেই তখন সল্টলেকে স্বাস্থ্য ভবনের সামনের ধর্নাস্থলে পৌঁছে গিয়েছেন বৈঠক ফেরত চিকিৎসকেরা। ধর্নামঞ্চ থেকে তাঁরাও জানালেন আলোচনা মোটের উপর সদ্‌র্থক। তাঁদের আন্দোলনের কাছে ‘নতিস্বীকার’ করেছে সরকার। কিন্তু কাজে ফেরার সিদ্ধান্ত এখনই নয় বলেই জানিয়ে দিলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। তাঁরা জানালেন বৈঠকে যে যে আশ্বাস মুখ্যমন্ত্রী দিয়েছেন, সেগুলো কার্যকর হলে তবেই আন্দোলন প্রত্যাহার করা হবে। বস্তুত, ধর্নাস্থল ছেড়ে যাওয়ার আগে আন্দোলনকারীরা ঘোষণা করেছিলেন, ‘‘কালীঘাটে কোনও সিদ্ধান্ত নেব না। এখানে ফিরে এসে সকলের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তাতে আন্দোলন আরও দীর্ঘ বা তীব্র হলে হবে।’’

    মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের অধিকাংশ দাবিই তাঁরা মেনে নিয়েছেন। এ বার আশা করছেন, আন্দোলনকারীরা কাজে ফিরবেন। মমতার কথায়, ‘‘৯৯ শতাংশ দাবি মেনে নিয়েছি। আর কী করব!’’ তিনি জানান, জুনিয়র ডাক্তারদের পাঁচটি দাবির প্রথমটি সিবিআই এবং আদালতের বিষয়। বাকি চারটির মধ্যে তিনটেয় মান্যতা দিয়েছে তাঁর সরকার। আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে কলকাতা পুলিশ কমিশনারের পদ থেকে বিনীত গোয়েলকে সরানো হবে। মঙ্গলবার বিকেল ৪টের পর এই সংক্রান্ত নোটিস দিয়ে দেওয়া হবে। বিনীতকে নিজের পছন্দের পদ দেওয়া হবে বলেও জানান মমতা। পাশাপাশি, চিকিৎসকদের দাবি মেনে কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (উত্তর) অভিষেক গুপ্তকেও সরানো হচ্ছে। সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে স্বাস্থ্য অধিকর্তা কৌস্তভ নায়েক, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিকর্তা দেবাশিস হালদারকেও। মমতা বলেন, ‘‘আমরা কাউকে অশ্রদ্ধা, অসম্মান করিনি। কিন্তু ওঁদের বিরুদ্ধে যে হেতু চিকিৎসকদের ক্ষোভ আছে, বলেছেন, ওঁদের উপর আস্থা নেই, তাই আমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’’ তিনি এ-ও জানান, চিকিৎসকদের দাবি মতো কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করবে সরকার। তিনি বলেন, ‘‘প্রায় ৬টা থেকে ১২টা পর্যন্ত বৈঠক হয়েছে। ওঁদের পক্ষ থেকে ৪২ জন সই করেছেন। সরকারের পক্ষ থেকে মিনিটসে্ সই করেছেন মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ। আমরা অভিনন্দন জানিয়েছি চিকিৎসকদের। আমরা খুশি যে, তাঁরাও খুশি। ওঁরা বক্তব্য রাখতে চেয়েছিলেন। সেই সুযোগ দিয়েছি। আমরাও আমাদের বক্তব্য রেখেছি।’’ এরই পাশাপাশি, রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় বন্যা পরিস্থিতি, ডেঙ্গি এবং ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাবের দিকে নজর রেখে জুনিয়র চিকিৎসকদের উদ্দেশে রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতার বার্তা, ‘‘প্লিজ়! এ বার কাজে ফিরুন।’’

    কিন্তু ধর্নাস্থল থেকে অন্য কথা উঠে এল। আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধি জুনিয়র ডাক্তার দেবাশিস হালদার বলেন, “আন্দোলনকারীদের কাছে নতস্বীকার করল রাজ্য সরকার। ৩৮ দিন পর আমাদের জয় হয়েছে। এই জয় সাধারণ মানুষ, চিকিৎসক, নার্স— সকলের। সবাই পাশে না থাকলে এই জয় সম্ভব ছিল না। সে জন্য সকলকে ধন্যবাদ।” তাঁর সংযোজন, “আশ্বাস বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত আমরা ধর্না বিক্ষোভ নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেব না। সুপ্রিম কোর্টের শুনানির পর আমরা আলোচনায় বসে সিদ্ধান্ত নেব।” পাশাপাশি চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে যে দুর্নীতি, ‘থ্রেট কালচার’ তৈরি হয়েছে, তা সমূলে উপড়ে ফেলতে হবে। এ বিষয়ে ভবিষ্যতে সরকারের সঙ্গে আলোচনার পথ খোলা থাকবে বলেও জানান তাঁরা। চিকিৎসকদের এক প্রতিনিধি বলেন, “যেটুকু দাবি আমরা পূরণ করিয়ে আনতে পেরেছি, সেটাও আমাদের আন্দোলনের জয়। এটুকু পেতে আমাদের ৩৮ দিন সময় লেগে গেল।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের শুনানি রয়েছে সে দিকে নজর থাকবে আমাদের। এ ছাড়াও কত দিনে আমাদের দাবিগুলি বাস্তবায়িত হয় সে দিকেও নজর থাকবে আমাদের।”

    চিকিৎসকদের ধর্না এবং প্রথম সরকারি প্রয়াস

    আরজি করে মহিলা চিকিৎসকের ধর্ষণ-খুনের ঘটনার প্রতিবাদে স্বাস্থ্য ভবনের সামনে ধর্নায় বসেছেন জুনিয়র চিকিৎসকেরা। সোমবার ছিল ধর্নার সপ্তমতম দিন। এই কয়েক দিনের মধ্যে রাজ্যের তরফে জট কাটানোর চেষ্টা হয়। কিন্তু দুই পক্ষই নিজেদের কিছু অবস্থানে অনড় থাকায় বৈঠক হয়নি। প্রথম থেকেই ডাক্তারেরা চেয়ে এসেছেন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের সরাসরি সম্প্রচার। আন্দোলনকারী ডাক্তারদের প্রতিনিধি দলকে প্রথমে নবান্নে ডাকা হয়েছিল। একটি প্রতিনিধি দল নবান্নের সামনে পৌঁছেও গিয়েছিল। কিন্তু সরাসরি সম্প্রচারের দাবিতে তাঁরা অনড় থাকায় বৈঠক হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দেন, ২ ঘণ্টা ১০ মিনিট তিনি বসেছিলেন। চেয়েছিলেন সুষ্ঠু আলোচনার। কিন্তু তা হল না। অন্য দিকে, জুনিয়র চিকিৎসকেরা জানান, তাঁরাও চান কাজে ফিরতে। কিন্তু দাবি মেনে সরকার পক্ষ বৈঠকের সরাসরি সম্প্রচার করলে তবেই বৈঠক হবে।

    স্বাস্থ্য ভবনের সামনে ধর্নামঞ্চে আচমকা মুখ্যমন্ত্রী

    নবান্নে বৈঠক ভেস্তে যাওয়ার পর গত শনিবার আচমকাই সল্টলেকে স্বাস্থ্য ভবনের সামনে জুনিয়র ডাক্তারদের ধর্নামঞ্চে পৌঁছে যান মুখ্যমন্ত্রী মমতা। সেখান থেকে ডাক্তারদের কাজে ফেরার অনুরোধ করেন। সে দিনই বিকালে আন্দোলনকারীদের তাঁর কালীঘাটের বাড়িতে আলোচনার জন্য ডাকা হয়। আলোচনা শেষে শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে যান চিকিৎসকেরা। বৃষ্টির মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে পৌঁছে গিয়েছিল চিকিৎসকদের প্রতিনিধি দল। কিন্তু সে দিনও সরাসরি সম্প্রচার এবং বৈঠকের ভিডিয়োগ্রাফির দাবি নিয়ে শুরু হয় সরকার ও ডাক্তারদের মতানৈক্য। আবার ভেস্তে যায় বৈঠক। মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে অপেক্ষা করেছিলেন ডাক্তারেরা। মমতা বাড়ির বেরিয়ে এসে তাঁদের আলোচনার জন্য আহ্বান জানান। বৈঠক না করতে চাইলে অন্তত চা খাওয়ার জন্য আবেদন করেন। মমতা দাবি করেন, এ ভাবে তাঁকে ‘অসম্মান’ করা হচ্ছে। অন্য দিকে, জুনিয়র ডাক্তারেরা বলেন, এটা তাঁদের অভিপ্রায় নয়। তাঁরাও চান আলোচনা হোক। তবে বৈঠকের সরাসরি সম্প্রচার অথবা ভিডিয়ো রেকর্ড করতে দিতে হবে। শেষ পর্যন্ত বৈঠক হয়নি। কালীঘাট ছেড়ে আবার সল্টলেকের ধর্নামঞ্চে যাওয়ার সময় ডাক্তারেরা জানান, মুখ্যমন্ত্রীর কথা মতো নিজেদের সব শর্তই ছেড়ে দিয়েছিলেন তাঁরা। সরাসরি সম্প্রচার এবং ভিডিয়োগ্রাফি ছাড়াই বৈঠক করতে রাজি হয়েছিলেন। সরকারের দাবি মতো বৈঠকের কার্যবিবরণী লেখাতেই রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু শেষে তাঁদের বলা হয়, তিন ঘণ্টা মুখ্যমন্ত্রী অপেক্ষা করেছেন। আর বৈঠক সম্ভব নয়।

    আবার মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে আলোচনার প্রস্তাব

    আবার বৈঠকের জন্য জুনিয়র ডাক্তারদের ডাকে রাজ্য। সোমবার রাজ্যের পাঠানো ইমেলে জানানো হয় গত শনিবার ডাক্তারদের যে প্রতিনিধিরা বৈঠকের জন্য কালীঘাটে এসেছিলেন, সোমবারও তাঁদের যেতে অনুরোধ করা হচ্ছে। সোমবারও চিকিৎসকদের ৩০ জন প্রতিনিধিকেই ঢুকতে দেওয়া হতে পারে। ইমেলে বৈঠকের সময় দেওয়া হয় বিকেল ৫টা। বৈঠকস্থল মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি। মুখ্যসচিবের তরফে সকাল ১১টা ৪৮ মিনিটে ওই ইমেল পান জুনিয়র ডাক্তারেরা। ইমেলে জানানো হয়, সরকারের তরফ থেকে এটাই ‘পঞ্চম এবং শেষ চেষ্টা’। ইমেলে এ-ও বলা হয়, ‘‘গত ৯ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল, ১০ সেপ্টেম্বর বিকাল ৫টার মধ্যে জুনিয়র ডাক্তারদের কাজে ফিরতে হবে। নাগরিক হিসাবে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ পালন করা কর্তব্য। তাই এটা আপনাদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠক করানোর জন্য আমাদের তরফে পঞ্চম এবং শেষ প্রচেষ্টা। খোলা মনে আলোচনার জন্য কালীঘাটে মুখ্যমন্ত্রী বাড়িতে আপনাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আমরা বিশ্বাস করি, সুচিন্তার জয় হবেই।’’ এ-ও জানিয়ে দেওয়া হয় যে, আগের দিনের শর্ত অনুযায়ী এই বৈঠকেরও কোনও ভিডিয়োগ্রাফি বা সরাসরি সম্প্রচার হবে না কারণ, বিষয়টি সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন। পরিবর্তে বৈঠকের পুঙ্খানুপুঙ্খ কার্যবিবরণী প্রকাশ করা হবে, তাতে দু’পক্ষেরই সই থাকবে। ইমেল পেয়ে যদিও সুর নরম করেননি ডাক্তারেরা। তাঁদের কথায়, ‘‘‘খোলা মনে’ বৈঠকের জন্য শুরু থেকেই রাজি ছিলাম। এখনও রাজি। আমাদের পাঁচ দফা দাবি নিয়েই আমরা বৈঠকে যাব।’’

    দীর্ঘ বৈঠকের পর রাজি আন্দোলনকারীরা

    সরকারের তরফে বৈঠকের আমন্ত্রণ পাওয়ার পর সোমবার দুপুর পর্যন্ত বৈঠক করেন আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তাররা। শেষ পর্যন্ত তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, আলোচনায় যোগ দেবেন। দুপুর ৩টে ৫৩ মিনিটে চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে সরকারকে ইমেল করা হয়। সেখানে জানানো হয়, সাধারণ মানুষের স্বার্থে বৈঠকে যেতে তাঁরা ইচ্ছুক। তবে স্বচ্ছতার দাবিতে তাঁরা অনড়। বৈঠকে যেতে রাজি হলেও সরকারকে তিনটি শর্ত দেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। আন্দোলনকারীরা ইমেলে বলেন, ‘‘গত শনিবার টালা থানার (তৎকালীন) ওসি এবং আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের গ্রেফতারির ফলে বৈঠকের স্বচ্ছতা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের একমাত্র দাবি, দু’পক্ষই ভিডিয়ো করুক। সেটা সম্ভব না হলে দ্বিতীয় দাবি, সরকার ভিডিয়ো করুক। বৈঠক শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিডিয়ো আমাদের হাতে দিক। আর সেটাও যদি সম্ভব না হয়, তা হলে তৃতীয় দাবি, দু’পক্ষই বৈঠকের কার্যবিবরণী লিখবে। আমরা কার্যবিবরণী লেখার লোক নিয়ে যাব। সকলে সই করার পর তা আমাদের হাতে তুলে দিতে হবে। পাঁচ দফা দাবি নিয়েই আমরা আলোচনা করতে চাই। আমাদের শর্তে রাজি হলে সরকার অবিলম্বে জবাব দিক। আমরা বৈঠকে হাজির হওয়ার জন্য উদ্‌গ্রীব।’’ পাশাপাশি, মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি ছেড়ে যদি বৈঠকের জায়গা সরকারি কোনও জায়গা হত, সেটা ভাল হত বলেও জানিয়েছিলেন চিকিৎসকেরা।

    বৈঠকের শুরু

    শেষ পর্যন্ত শুরু হয় বৈঠক। মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে চিকিৎসকদের সঙ্গে দুই পেশাদার স্টেনোগ্রাফারকে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। অর্থাৎ, মিনিটস্ বা লিখিত কার্যবিবরণীর দাবি মেনে নেয় সরকার। আন্দোলনকারীদের সঙ্গেই আসেন তাঁরা। রাত পৌনে ৭টা নাগাদ মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে বৈঠক শুরু হয়। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে জুনিয়র ডাক্তারদের বৈঠকে সরকারি তরফে ছিলেন রাজ্যের মুখ্যসচিব মনোজ এবং স্বরাষ্ট্রসচিব নন্দিনী চক্রবর্তী। পাঁচ দফা দাবি জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর হাতে স্মারকলিপি তুলে দেন আন্দোলনকারীরা। সূত্রের খবর প্রায় ২ ঘণ্টা বৈঠক হয়। সরকারের সূত্রে জানা যায়, বৈঠক ইতিবাচক। শুরু হয় কার্যবিবরণী লেখার কাজ। সেই কাজও চলে প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে।

    বৈঠক শেষে কে কী বলছেন

    বৈঠক শেষ হওয়ার পর শাসকদল খুশি। তাদের দাবি, অবশেষে জট কেটেছে। তৃণমূল সাংসদ দেব এ নিয়ে একটি পোস্ট করেন সমাজমাধ্যমে। যদিও রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এই আলোচনা কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি সমাজমাধ্যমে লেখেন, ‘‘বৈঠকের কার্যবিবরণী থেকে বোঝা যাচ্ছে, অচলাবস্থার অবসান ঘটাতে উভয় পক্ষের মধ্যে একটি সমঝোতা হয়েছে। তবে যাই হোক, ন্যায়বিচারের জন্য শুধুমাত্র কয়েক জনের বদলি যথেষ্ট হবে না। প্রমাণ লোপাটে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন, তাঁদের জেলে যেতে হবে।’’ পাশাপাশি, চিকিৎসকের ধর্ষণ এবং খুনের বিচার না-পাওয়া পর্যন্ত বিজেপি আন্দোলন চালিয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন শুভেন্দু। শুভেন্দুর বিরোধিতা করেছেন তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ। তাঁর অভিযোগ, অপপ্রচার করেছেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা।

    বিভিন্ন চিকিৎসক সংগঠন ডাক্তারদের জয় হিসাবেই দেখছেন এই বৈঠককে। মেডিক্যাল সার্ভিস সেন্টারের রাজ্য সম্পাদক বিপ্লব চন্দ্র বিবৃতিতে বলেন, ‘‘দীর্ঘ ৩৮ দিন পর জুনিয়র ডাক্তারদের এক ঐতিহাসিক আন্দোলন জয়ের মুখ দেখল। আমরা দেখলাম আন্দোলনই পারে, জয় ছিনিয়ে আনতে।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘এখনও পর্যন্ত যে সমস্ত দাবি পূরণ হয়নি— প্রকৃত খুনিরা ধরা পড়েনি, তার জন্য আন্দোলনকে চালিয়ে যেতে হবে।’’

    যে খাতে বইছে আরজি করের তদন্ত

    চিকিৎসককে ধর্ষণ এবং খুনের মামলায় গত শনিবার আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ এবং টালা থানার তৎকালীন ওসি অভিজিৎ মণ্ডলকে গ্রেফতার করেছে সিবিআই। কর্তব্যে গাফিলতি, প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা, এফআইআর দায়েরে দেরির মতো অভিযোগ রয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে। তার আগেই অবশ্য আরজি করের দুর্নীতি মামলায় সন্দীপকে গ্রেফতার করে সিবিআই। তদন্ত করছে ইডি-ও। চিকিৎসকের ধর্ষণ এবং খুন মামলায় সিবিআই আদালতে দাবি করেছে, আরজি কর-কাণ্ডে অভিজিতের ভূমিকা ‘সন্দেহজনক’। নেপথ্যে ‘বৃহত্তর ষড়যন্ত্র’ থাকতে পারে। এ-ও অভিযোগ করা হয়, তদন্তের অভিমুখ ঘুরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন অভিজিৎ। তাঁকে তিন দিনের সিবিআই হেফাজতে পাঠিয়েছে আদালত। ধর্ষণ-খুনের মামলায় সন্দীপকেও হেফাজতে পেয়েছে সিবিআই।

    অভিজিতের পাশে কলকাতা পুলিশ

    সোমবার দুপুরে টালা থানার তৎকালীন ওসি অভিজিতের সার্ভে পার্কের বাড়িতে গিয়েছিলেন কলকাতা পুলিশের উচ্চপদস্থ আধিকারিকেরা। সেখানে ছিলেন কলকাতা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (চতুর্থ) ভি সলোমন নেসা কুমার, ডেপুটি কমিশনার (দক্ষিণ-শহরতলি) বিদিশা কলিতা এবং ডেপুটি কমিশনার (পূর্ব) আরিশ বিলাল। কলকাতা পুলিশের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়, ওসি-র পাশেই রয়েছে তারা। ওসি নিজের কর্তব্যে গাফিলতি করেছেন, এমনটা মনে করছে না দফতর।

    পুজো ও জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতি

    অতঃপর সাত দিন কেটে গিয়েছে। স্বাস্থ্য ভবনের সামনে এখনও ধর্নায় জুনিয়র ডাক্তারেরা। সামনে দুর্গাপুজো। বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব। মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের আন্দোলনরত মানুষকে বার্তা দিয়েছিলেন ‘উৎসবে ফেরা’র জন্য। এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হয় রাজনৈতিক শিবিরে। আড়াআড়ি বিভক্ত হন নেটাগরিকেরা। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য প্রসঙ্গে আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের অন্যতম কিঞ্জল নন্দ বলেন, “এমন নয় যে বাংলায় ২০০ বছর ধরে কোনও দুর্গাপুজো হয়নি। দুর্গাপুজো হয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রাম তার জন্য প্রভাবিত হয়নি। স্বাধীনতাও এসেছিল। আমার মনে হয়, এ বারের পুজোও ঠিক সেই রকমই হবে।”

    দিল্লি থেকে জুনিয়র ডাক্তারদের বার্তা

    দিল্লির জুনিয়র ডাক্তারদের সংগঠন ‘রেসিডেন্ট ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন’ (আরডিএ) পশ্চিমবঙ্গে আন্দোলন জুনিয়র ডাক্তারদের সংগঠন ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টরস ফ্রন্ট’-এর সঙ্গে দিল্লি প্রেস ক্লাবে যৌথ সাংবাদিক বৈঠক করেছে সোমবার। যৌথ সাংবাদিক বৈঠকে বাংলার জুনিয়র ডাক্তারদের সুরে সুর মিলিয়েই আরডিএ-র প্রতিনিধিরা আরজি কর-কাণ্ডের তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। সেই সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিয়েও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তাঁরা। অভিযোগ করা হয়, এখনও রাজ্য সরকারের তরফে জুনিয়র ডাক্তারের সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে কর্মবিরতিতে ইতি টানার জন্য প্রয়োজনীয় সদিচ্ছা দেখা যায়নি। আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধি বলেন, ‘‘আরজি করের ঘটনার পরে পুলিশের ভূমিকা কী ছিল, ওসির গ্রেফতারির ঘটনাতেই তা স্পষ্ট।’’

    অতঃপর

    মঙ্গলবার আরজি কর মামলার চতুর্থ শুনানি রয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। কাজে যোগ না দেওয়ার জন্য কর্মবিরতিতে অংশ নেওয়া জুনিয়র ডাক্তারদের শীর্ষ আদালতে অস্বস্তিতে পড়তে হতে পারে কি না, তা নিয়ে তৈরি হয়েছে জল্পনা। এ বার জুনিয়র ডাক্তারদের হয়ে সওয়াল করবেন প্রবীণ আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিংহ। আরজি কর মামলায় এখনও পর্যন্ত যুক্ত হয়েছে ৩৪টি পক্ষ। মামলা লড়ছেন কম করে ২০০ জন আইনজীবী। আইনি লড়াইয়ে এই মমলায় যেমন রয়েছেন দেশের সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা, তেমনই রয়েছেন কপিল সিব্বল। রাজ্য সরকারের তরফে কপিলই সওয়াল করছেন। মামলায় যুক্ত হয়েছেন বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য এবং ফিরদৌস শামিমের মতো আইনজীবীরা।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)