দু'বার ছিল বাম জমানা। আর পরের দু'বার তৃণমূলের আমল। গত ৩২ বছরে এমন পরিস্থিতি ঘুরে এলো মোট চারবার। সাধারণ মানুষের ক্ষোভ হাতের বাইরে চলে যাওয়ায় কলকাতা পুলিশের নগরপালের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো আরও এক আইপিএস কর্তাকে। এবার, বিনীত গোয়েল।ইতিহাস বলছে, ৯২ সালে বাম আমলের মধ্য গগনে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু সরাতে বাধ্য হয়েছিলেন কলকাতা পুলিশের কমিশনার বীরেন সাহাকে। একজন 'কুখ্যাত' ব্যক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ ওঠায় সরিয়ে দেওয়া হয় খোদ পুলিশ কমিশনারকেই। সেবার অবশ্য এখনকার মতো এত বিক্ষোভ দেখাননি কেউ। কোনও রাজনৈতিক দলও নয়।
কিন্তু কী হয়েছিল সেবার?
অস্কারজয়ী, বিশ্ববন্দিত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের শেষকৃত্যের রাতে কেওড়াতলা শ্মশানের ভিআইপি বিশ্রামাগারে তাণ্ডব চালিয়েছিলেন ৩০ বছরের এক যুবক। প্রয়াত সিপিএমের প্রাক্তন সাংসদ বিপ্লব দাশগুপ্তের পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরেছিলেন তিনি। কর্তব্যরত পুলিশ অফিসারদের উপরে চড়াও হয়ে দাবি করেছিলেন, তাঁর সঙ্গে কথা বলতে আসতে হবে 'সাহাদা'কে।
অন্ত্যেষ্টিতে উপস্থিত একঝাঁক নামী-দামি ব্যক্তিত্বের সামনে সেই ঘটনায় ক্ষুব্ধ তৎকালীন তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নির্দেশে অভিযুক্ত শ্মশান স্বপনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এই নিয়ে প্রবল বিতর্ক শুরু হওয়ায় পদ হারাতে হয় তৎকালীন পুলিশ কমিশনার বীরেন সাহাকে। নতুন সিপি হন তুষার তালুকদার। সামনে আসে, কেওড়াতলা সহ কলকাতার একাধিক শ্মশানঘাটে মৃতদেহ বহনকারী খাট বিক্রি চক্রের। যার অন্যতম অংশীদার শ্মশান স্বপন। খোদ অভিযুক্ত কমিশনারের নাম মুখে আনায় পদ হারাতে হয় পুলিশ কর্তাকে।
এরপরের ঘটনাটি ঘটে ১৫ বছর বাদে ২০০৭ সালের ১৪ অক্টোবর। রিজওয়ানুর রহমানের রহস্য মৃত্যু নিয়ে কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে শুরু হয় আন্দোলন। অভিযোগ ছিল, এক শিল্পপতির মেয়েকে বিয়ে করায় পুলিশ হুমকি দেয় রিজওয়ানুরকে। আর তার জেরে রহস্য মৃত্যু হয় ওই যুবকের। ঘটনার ২৬ দিনের মাথায় দুর্গাপুজোর ষষ্ঠীর দিন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সরিয়ে দেন পুলিশ কমিশনার প্রসূন মুখোপাধ্যায়কে। তাঁর ছেড়ে যাওয়া চেয়ারে বসেন এডিজি(টেলিকম) গৌতম মোহন চক্রবর্তী।
তৃতীয় ঘটনাটি ঘটে ২০১৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। গার্ডেনরিচের হরিমোহন ঘোষ কলেজে নির্বাচনের ডিউটিতে গিয়েছিলেন কলকাতা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের এসআই তাপস চৌধুরী। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া ঘিরে গোলমাল থামাতে গিয়ে গুলিতে প্রাণ হারান তিনি। ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে শাসক দলের নেতা তথা ১৫ নম্বর বরোর প্রাক্তন চেয়ারম্যান মহম্মদ ইকবাল ওরফে মুন্নার বিরুদ্ধে।
বিষয়টি নিয়ে পুলিশের অন্দরেই প্রবল ক্ষোভ দেখা দেয়। তড়িঘড়ি ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডির হাতে। রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দারা তদন্তে নেমে জানতে পারেন, মহম্মদ সুভান নামে স্থানীয় এক দুষ্কৃতী প্রাক্তন বরো চেয়ারম্যানের হয়ে ভোট করাতে ওখানে এসেছিলেন। সুভানের গুলিতেই নিহত হন তাপসবাবু। ঘটনার পরে পালিয়ে যান মুন্না। সুভান, ইবনে-সহ কয়েক জনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি।
পরে মুন্নাকে ডেহরি-অন-শোন থেকে পাকড়াও করা হয়। পুলিশের কর্মীদের 'বিদ্রোহ' থামাতে তড়িঘড়ি সরিয়ে দেওয়া হয় পুলিশ কমিশনার রঞ্জিত পচনন্দাকে। তাঁর জায়গায় কলকাতার নগরপাল করা হয় রাজ্য পুলিশের এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) সুরজিৎ কর পুরকায়স্থকে।
ফের আরও একবার ১১ বছর পরে আরজি কর ইস্যুতে কমিশনারের পদ ছাড়তে হলো ১৯৯৪ ব্যাচের অফিসার বিনীত গোয়েলকে। সিপির চেয়ারে বসলেন তাঁর থেকে চার ব্যাচ জুনিয়র এডিজি(আইনশৃঙ্খলা) মনোজ ভার্মা।
পুলিশ কর্তাদের বক্তব্য, 'কলকাতা পুলিশের সিপি পদ অত্যন্ত গ্ল্যামারাস। তবে চেয়ারটাতে কাঁটা বিছানো। কেউ তা সামলাতে পারেন, কারও পচা শামুকে পা কাটে।'