এই সময়, কলকাতা ও নয়াদিল্লি: আরজি করে ধর্ষণ-খুনের তদন্তে নেমে বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত আগেই দিয়েছিল সিবিআই। টালা থানার প্রাক্তন ওসি অভিজিৎ মণ্ডল ও আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে এই মামলায় গ্রেপ্তারির পর রবিবার শিয়ালদহ কোর্টে তদন্তকারীরা দাবি করেছিলেন, ইচ্ছাকৃত ভাবে অভিযুক্ত সঞ্জয় রায় ও অন্য সন্দেহভাজনদের আড়াল করতেই অনেক দেরিতে ক্রাইম সিন সুরক্ষিত রাখা বা ধৃতের পোশাক বাজেয়াপ্ত করার কাজ করেছিল পুলিশ।মঙ্গলবার আবার শিয়ালদহ আদালতে সিবিআই দাবি করল, অভিজিৎ ও সন্দীপের মোবাইলের কল ডিটেলস রেকর্ড (সিডিআর) পরীক্ষা করে আরও বেশ কয়েকটি সন্দেজনক ফোন নম্বর মিলেছে। পাশাপাশি ঘটনার আশপাশের সময়ে হাসপাতালের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে কয়েকজন ব্যক্তির সন্দেহজনক উপস্থিতিও নজরে এসেছে। সেই বিষয়গুলি খতিয়ে দেখতে দু'জনকে ফের নিজেদের হেফাজতে নিয়ে জেরা করা প্রয়োজন। ফলে ধর্ষণ-খুন এবং তারপরে তথ্যপ্রমাণ লোপাটের পিছনে পূর্ব পরিকল্পনা করা এবং গোটা ঘটনার নেপথ্যে আরও কয়েকজনের যোগসাজশ থাকার সম্ভাবনা আরও জোরালো হচ্ছে।
এখনও পর্যন্ত এই মামলার তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে এ দিন সকালেই সুপ্রিম কোর্টে স্টেটাস রিপোর্ট জমা দেয় সিবিআই। সেই রিপোর্টের বিস্তারিত খোলা আদালতে প্রকাশ করেননি প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়। তবে সেই রিপোর্ট দেখে সিজেআই বলেন, 'সিবিআই স্টেটাস রিপোর্টে যা বলেছে, তা ভয়াবহ, বিচলিত হওয়ার মতো৷ খুবই ডিস্টার্বিং৷'
আরজি করের নির্যাতিতার ন্যায় বিচার মিলবে কবে, সেই প্রত্যাশা নিয়েই শীর্ষ আদালতে সিবিআইয়ের দেওয়ার রিপোর্টের দিকে তাকিয়ে রয়েছে গোটা দেশ। এখনও পর্যন্ত সিবিআইয়ের তদন্ত নিয়ে এ দিন সন্তোষ প্রকাশ করে সুপ্রিম কোর্ট। প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় বলেন, 'আমরা এটা বলব না, কোন পথে সিবিআই তদন্ত চলছে৷ তবে আমরা আশ্বস্ত করতে পারি, প্রকৃত তথ্য খুঁজে বের করার জন্যই তদন্ত হচ্ছে৷ আমরা সিবিআইয়ের রিপোর্ট প্রকাশ করে গোটা তদন্তকে বিপথে চালিত করতে পারি না৷ আগামী দিনে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সামনে আসবে৷'
তাঁর ইঙ্গিতপূর্ণ সংযোজন, 'অভিযুক্ত, গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের যোগাযোগ, তথ্যপ্রমাণ নষ্ট, অন্য কোনও ব্যক্তির ঘটনায় জড়িত থাকা- সব কিছুই তদন্ত করছে সিবিআই৷ ভয়েস স্যাম্পল খতিয়ে দেখা হচ্ছে৷ অন্যান্য এজেন্সির সঙ্গেও আলোচনা করা হচ্ছে৷ সিবিআই ঘুমোচ্ছে না৷ তাদের সময় দিতে হবে তদন্ত করতে৷ এক সপ্তাহের মধ্যে এই তদন্ত শেষ হবে না৷ আমরা সবাই চাই, প্রকৃত তথ্য সামনে আসুক৷ সিবিআই সেই পথেই তদন্ত করছে৷' কেন্দ্রের তরফে সলিসিটার জেনারেল তুষার মেহতা বলেন, 'আমরা চার্জশিট ফাইল করার সময়েও সতর্ক থাকব৷ কোনও ভাবেই অভিযুক্তদের বাড়তি সুযোগ পেতে দেওয়া যাবে না৷'
সিবিআইকে বেশ কয়েকটি তথ্য জানিয়ে একটি চিঠি দিয়েছিলেন নির্যাতিতার বাবা-মা। সেই চিঠির প্রতিলিপি দেওয়া হয়েছিল সিজেআইয়ের কাছে। এ দিন সেই প্রসঙ্গ টেনে সিজেআই চন্দ্রচূড় বলেন, 'চিঠিতে মৃতার বাবার জেনুইন উদ্বেগ ধরা পড়েছে। উনি যেটা জরুরি বলে মনে করছেন সেটাই জানিয়েছেন। স্টেটাস রিপোর্টে এই বিষয়গুলির কয়েকটির উল্লেখ আছে৷ সিবিআই এই গুরুত্বপূর্ণ লিডগুলি নিশ্চিত ভাবে খতিয়ে দেখবে৷'
শীর্ষ আদালতের পর্যবেক্ষণের প্রেক্ষিতে এ দিন নির্যাতিতার বাবা বলেন, 'সর্বোচ্চ আদালত তদন্তের গতিপ্রকৃতি নিয়ে সিবিআইয়ের দেওয়া স্টেটাস রিপোর্টের ভিত্তিতে বিচলিত হওয়ার বিষয়টি যথার্থই বলেছেন। আমরা প্রথম দিন থেকে এই কথাগুলো বলে এসেছি। তথ্যপ্রমাণ লোপাট হয়ে থাকলে তদন্তকারী সংস্থার খুঁজে পেতে সমস্যা হয়। এখানে তথ্যপ্রমাণ লোপাটের ঘটনা ঘটেছে।'
এ দিন শিয়ালদহ আদালতে সিবিআই আইনজীবী দাবি করেন, 'অভিজিৎ ও সন্দীপ- দু'জনের মোবাইলের সিডিআর থেকে আরও সন্দেহজনক মোবাইল নম্বর সামনে এসেছে। সেগুলি খতিয়ে দেখতে হবে। যে সিসিটিভি ফুটেজ বাজেয়াপ্ত হওয়ার পর ফরেন্সিকে পাঠানো হয়েছিল, তাতেও সন্দেহজনক অনেকের চলাফেরা ধরা পড়েছে। সে বিষয়ে তথ্য পেতে দু'জনকে মুখোমুখি জেরা করার প্রয়োজন।'
তাঁর সওয়াল, 'নির্যাতিতার পরিবার দ্বিতীয় বার ময়নাতদন্ত করতে চাইলেও মৃতদেহের সৎকার করতে ওসি এবং অধ্যক্ষই তাড়াহুড়ো করেছেন। দু'জন তথ্যপ্রমাণ লোপাটের চেষ্টা করেছেন। ষড়যন্ত্রের ঘটনা ঘটেছে। তদন্তে এখনও অনেক কিছু বাকি রয়েছে।' যদিও অভিজিতের হয়ে আইনজীবী সেলিম রহমান ও অয়ন ভট্টাচার্যরা বলেন, 'উনি তদন্তকারী অফিসার ছিলেন না। সহযোগী ছিলেন। তদন্তে যুক্ত থাকা সরকারি অফিসারকে পদ্ধতি মেনে গ্রেপ্তার করা হয়নি। কলকাতা পুলিশের কাছ থেকে অনুমতিও নেওয়া হয়নি। তদন্তকারীরা বলতে পারছেন না, তাঁকে কেন ধর্ষণ-খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হলো। ওঁর গাফিলতি হতে পারে, কিন্তু উনি ষড়যন্ত্রে যুক্ত নন।'
বিচারক শিবাশিস দে সিবিআইয়ের উদ্দেশে বলেন, 'আপনারা ষড়যন্ত্রের কথা বলছেন। ধর্ষণ ও খুনের ষড়যন্ত্র করা হয়েছে, নাকি প্রমাণ লোপাটে ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। আপনাদের কাছে কোনও নির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ আছে, যার মাধ্যমে বোঝা যাবে ধর্ষণ-খুনের ঘটনায় তাঁরা যুক্ত রয়েছেন?' আরজি করে ধর্ষণ-খুনে একজনই জড়িত, নাকি সেখানে গণধর্ষণ হয়েছিল- তাও জানতে চান বিচারক। সিবিআইয়ের তরফে জানানো হয়, এখনও পর্যন্ত ধর্ষণ-খুনে একজনই গ্রেপ্তার হয়েছে। সিবিআই কৌঁসুলি বলেন, 'আমরা সবদিক খতিয়ে দেখছি। খুব প্রাথমিক পর্যায়ে তদন্ত চলছে।'
তাঁর সংযোজন, 'এমনও হতে পারে যে, এই ঘটনার আগে কোনও ষড়যন্ত্র হয়েছে। সন্দীপ ইচ্ছাকৃত ভাবে এফআইআর করতে দেননি। কিন্তু, তা বলে ওসি এফআইআর করবেন না কেন? কে আটকেছে? এটা ষড়যন্ত্র।' দু'পক্ষের সওয়াল-জবাব শুনে ধৃত দু'জনের আরও ৩ দিনের সিবিআই হেফাজতের আবেদন মঞ্জুর করেন বিচারক।
এ দিন সুপ্রিম কোর্টে আরজি করের ঘটনায় কলকাতা পুলিশের প্রাথমিক তদন্ত নিয়ে আবারও প্রশ্ন তোলেন মামলাকারীর অন্যতম আইনজীবী ফিরোজ এডুলজি। তাঁর সওয়াল, 'নির্যাতিতার পরনের জিন্স ও অন্তর্বাস কেন ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকের কাছে পাঠানো হলো না?কলকাতা পুলিশ যে সব ডিভাইস ব্যবহার করেছে, তাতে অকুস্থলের ফিঙ্গারপ্রিন্ট, ডকুমেন্ট নষ্ট হতে পারে৷ সিবিআইকে মাত্র ২৭ মিনিটের ফুটেজ দেওয়া হয়েছে৷'
রাজ্যের তরফে আইনজীবী কপিল সিবাল বলেন, 'সিবিআইকে সব ফুটেজ দেওয়া হয়েছে, প্রায় ৭৮ ঘণ্টার ফুটেজ৷ এখন বলা হচ্ছে ২৭ মিনিটের ফুটেজ দেওয়া হয়েছে৷ ডিজিটাল ভিডিয়ো রেকর্ডার (ডিভিআর) সিল করা অবস্থায় দেওয়া হয়েছিল সিবিআইকে। ৩২জিবি পেনড্রাইভে ফুটেজ দেওয়া হয়েছিল।' যদিও কেন্দ্রের তরফে সলিসিটার জেনারেল মেহতার বক্তব্য, 'ডিভিআর-এ মাত্র ২৭ মিনিটের ফুটেজ আছে৷ আর পেন ড্রাইভের ক্যাপাসিটি গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো ফুটেজটা।'
সিবাল পাল্টা যুক্তি দেন, 'এতদিন ধরে এগুলি সিবিআইয়ের হাতে আছে৷ ওরা চেক করে দেখেনি কেন? এটা তদন্তের বিষয়৷' জুনিয়র ডাক্তারদের তরফে বর্ষীয়ান আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিং আদালতকে বলেন, 'আমরা কয়েকজনের নাম জানি, যাঁরা অকুস্থলে উপস্থিত ছিলেন কোনও প্রয়োজন ছাড়াই৷ আমরা সিল বন্ধ খামে সেই সব তথ্য সিবিআইকে জানাতে চাই৷' প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় নিজেই সেই সিলবন্ধ খাম খুলে দেখেন। পরে তা সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়।