বন্যা নিয়ে পুরনো অবস্থানই নিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভিডিসি-র উপর দায় চাপিয়ে ফের ‘ম্যান মেড বন্যা’র তত্ত্বে অনড় রইলেন তিনি। আর ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে দিলেন প্রতিশ্রুতি। জানালেন, অপেক্ষা করতে হবে বছর দুয়েক।
বৃষ্টি হলে জল ছাড়বে ডিভিসি। সেই জলে ভাসবে ঘাটাল-সহ রাজ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। তারপরই শুরু হবে চাপানউতোর। এই চেনা ছবির বদল হল না এ বারও। ঘাটালের বন্যা পরিস্থিতির ক্রমশ অবনতি হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বুধবার ঘাটালে এসে বন্যা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখলেন মুখ্যমন্ত্রী। ঘাটালের রানিরবাজারে জলে দাঁড়িয়ে এই বন্যাকে ‘ম্যান মেড’ বলে অভিযোগ করেন করেন তিনি। এই ‘ম্যান মেড’ বন্যার তত্ত্ব বিরোধী নেত্রী থাকার সময় থেকেই শোনা গিয়েছে মমতার মুখে।
বৃষ্টি হলে যেমন ‘ম্যান মেড’ বন্যার কথা ওঠে ভোট এলেই তেমনি ভেসে ওঠে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান। এ বারও তার অন্যথা হয়নি। লোকসভা ভোটের আগে মমতা নিজে জানিয়েছেন, কেন্দ্রের মুখাপেক্ষী না হয়ে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণ করবে রাজ্যই। এ দিন বন্যা কবলিত এলাকায় গিয়ে মমতা বলেছেন, ‘‘ডিপিআর তৈরি হয়েছে। দেড় হাজার কোটি টাকা লাগবে। বছর দুয়েকের মধ্যেই মাস্টার প্ল্যান করে দেব।’’
এ দিন বিকেলে হুগলি থেকে সড়ক পথে ঘাটালে পৌঁছন মুখ্যমন্ত্রী। ঘাটাল-চন্দ্রকোনা সড়কে এখন কোমর সমান জল। ঘাটালের রানিরবাজারে নামেন তিনি। জলে নেমে কথা বলেন দুর্গতদের সঙ্গে। স্থানীয় এক তরুণী শাশ্বতী পণ্ডিত মুখ্যমন্ত্রীকে কাছে পেয়ে বলেন, ‘‘বন্যার জলে ঘর ভেঙে গিয়েছে। বাড়িতে ক্যানসার রোগী রয়েছে।’’ একটি ঘরের দাবি করেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী আশ্বাস পেয়ে খুশি ওই তরুণী। মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিকের বলেন, ‘‘রাজ্যকে না জানিয়ে ডিভিসি জলাধার থেকে জল ছাড়া হয়েছে। সাড়ে তিন লক্ষ কিউসেক জল ছাড়া হয়েছে। ২০০৯-এর পর এত জল এর আগে ছাড়া হয়নি। পরিকল্পিত ভাবে বাংলায় বন্যা পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে। আমি নিজে ডিভিসির সঙ্গে কথা বলেছি। হাত জোড় করে বলেছি, এখানে বৃষ্টি হচ্ছে। অন্য রাজ্যকে বাঁচাতে বাংলাকে বঞ্চনা করা হচ্ছে। তাই আমি বলছি এটা পুরোপুরি ম্যান মেড বন্যা।’’ স্থানীয়েরা পানীয় জলের সমস্যার কথাও জানান মুখ্যমন্ত্রীকে। দ্রুত প্রশাসনের তরফে জলের পাউচ পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।
ঘাটাল থেকে সড়ক পথেই চন্দ্রকোনা হয়ে মেদিনীপুরে যান মুখ্যমন্ত্রী। সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ সার্কিট হাউসে পৌঁছন তিনি। আজ, বৃহস্পতিবার মেদিনীপুর থেকে পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়ায় যাওয়ার কথা তাঁর। বন্যা পরিস্থিতি পরিদর্শনে। সার্কিট হাউসের সামনে মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়েছিল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন দেখতে পেয়ে বিধায়ক দীনেন রায়দের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। মেদিনীপুর গ্রামীণের কিছু এলাকাও জলমগ্ন হয়ে পড়েছে, সুযোগ পেয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে এ কথা জানিয়েছেন দীনেন। দুর্গত মানুষের পাশে থাকতে হবে, বিধায়ককে নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
এ দিনও ঘাটালের বন্যা পরিস্থিতির সার্বিক অবনতি হয়েছে। দুটি গ্রাম পঞ্চায়েত ছাড়া কার্যত গোটা ঘাটাল এখন জলের তলায়। ঘাটাল-চন্দ্রকোনা, ঘাটাল-খড়ার সড়কে জল থাকায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। ঘাটাল-নাড়াজোল সড়কও জলের দখলে। ঘাটালেই লক্ষাধিক মানুষ জলবন্দি। এ দিন ঘাটালে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় ঘাটালে আসেন জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের প্রধান সচিব সুরেন্দ্র গুপ্ত। আসেন জেলা শাসক খুরশিদ আলি কাদেরী। দফায় দফায় বৈঠক করেন।
ডুবেছে ঘাটালের সবকটি শ্মশানও। ফলে মৃতদেহ নিয়ে নৌকায় করে ঘুরতে হচ্ছে। জলের তোড়ে প্রতিদিন মাটির বাড়ি ভাঙছে। ঘাটালের জলমগ্ন প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে বহু মানুষ নদীর পাড়ে বা উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন। খোলা আকাশের নীচে ত্রিপল খাটিয়ে বহু মানুষ রয়েছেন। প্রশাসনের তরফে অবশ্য ত্রাণ শিবির খোলা হয়েছে। তবে সকলে ত্রাণ শিবিরে পৌঁছতে পারছে না বলে অভিযোগ। কারণ, নৌকার অভাব। ব্লকের আজবনগর, দেওয়ানচক, মনসুকা, মোহনপুর, বীরসিংহ, সুলতানপুর,ইড়পালা সহ বিভিন্ন গ্রাম পঞ্চায়েতের অধিকাংশ একতলা বাড়ি ডুবে রয়েছে। সেখানে মূলত পানীয় জলের হাহাকার দেখা দিয়েছে। বিদ্যুৎ নেই। অভাব মোমবাতির। সমস্যা রয়েছে জ্বালানিরও।
ইড়পালার কল্পনা মালিক, বাসন্তী পোড়েদের আক্ষেপ, ‘‘পানীয় জল পাচ্ছি না। কোথায়, কী ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে জানি না। গলা ভর্তি জল পেরিয়ে জল আনতে হচ্ছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। কী ভাবে দিন কাটছে প্রশাসন এসে দেখে যাক।’’ ঘাটালের সঙ্গে চন্দ্রকোনার দুই ব্লকেও বন্যা পরিস্থিতিও ভয়াবহ। দুটি ব্লকের সাতটি গ্রাম পঞ্চায়েতের চল্লিশ-পঞ্চাশটি গ্রাম পুরোপুরি জলের তলায় চলে যায়। পানীয় জল, বিদ্যুতের সমস্যা রয়েছে সেখানেও। জেলাশাসক খুরশিদ আলি কাদেরী বলেন, “ঘাটালে পর্যাপ্ত পানীয় জলের পাউচ বিলি করা হচ্ছে। আরও যেখানে যেখানে সমস্যা, খবর পাওয়া মাত্রই পাঠানো হচ্ছে। দুর্গত এলাকায় প্রশাসনের তরফ থেকে বাড়ি বাড়ি ঘিরে ত্রিপল এবং শুকনো খাবার পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। প্রসূতি এবং অসুস্থদের নৌকায় করে উদ্ধার করে হাসপাতালে আনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি নজরদারি চালাচ্ছেন।”