কাজে ফিরতে চান আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারদের একটা বড় অংশ। তাঁদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এতদিন ধরে লড়াই চালানো বেশ কিছু সিনিয়র চিকিৎসকেরও তাই মত। কিন্তু, তাঁদের একাংশের অভিযোগ, জুনিয়ররা কাজে ফিরুক, চাইছেন না সিপিএম-সমর্থিত চিকিৎসকদের অনেকেই। অভিযোগ, ‘ভুল’ বুঝিয়ে আন্দোলন-কর্মবিরতি চালিয়ে যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে।এই অভিযোগের আঙুল উঠেছে মূলত ‘অ্যাসোসিয়েশন অফ হেলথ সার্ভিস ডক্টরস’-এর সদস্যদের একাংশের বিরুদ্ধে। উল্লেখ্য, আন্দোলনকারীদের দাবি মেনে কলকাতা পুলিশ ও স্বাস্থ্য দপ্তরের দুই কর্তাকে সরিয়ে দেওয়ার পরেও রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিবকে সরানো এবং হাসপাতালে নিরাপত্তার দাবি নিয়ে বুধবার আবার সরকারের সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন জুনিয়র চিকিৎসকেরা।
তাঁরা কর্মবিরতি তুলবেন কি না, বুধবার রাত পর্যন্ত সে ধোঁয়াশা কাটেনি। বেশ কিছু সিনিয়র চিকিৎসকের অভিযোগ, ২০১১ সাল থেকে কার্যত ঘরে ঢুকে গিয়েছে সিপিএম। গত নির্বাচনগুলিতে তাদের হাল সাধারণ মানুষ দেখেছে। ৯ অগস্ট আরজি কর হাসপাতালের ঘটনার পরে রাজপথে আন্দোলনের যে ঢেউ আছড়ে পড়েছে, সেখানে বিজেপি বা তাদের সহযোগী কোনও সংগঠন দাঁত ফোটাতে না-পারলেও, সিপিএম ঢুকেছে।
বিপুল সংখ্যক সাধারণ অরাজনৈতিক মানুষের পাশাপাশি সেখানে দেখা গিয়েছে অতি-বাম সমর্থক ও এসইউসিআই কর্মীদেরও। অভিযোগ উঠছে, জুনিয়র ডাক্তারদের সামনে রেখে বর্তমান সরকারকে কোনঠাসা করার এই ‘সুবর্ণ সুযোগ’ হাতছাড়া করতে চাইছে না সিপিএম।
সিনিয়র চিকিৎসকদের একাংশের বক্তব্য, ‘এই আবহে চিকিৎসকদের সবচেয়ে শক্তিশালী সংগঠন ওয়েস্ট বেঙ্গল মেডিক্যাল কাউন্সিল দখল-ই এখন সিপিএমের পাখির চোখ। তাতে কিছুটা অক্সিজেন পাওয়া যাবে। যা কাজে আসবে আগামী নির্বাচনেও।’ ওই সিনিয়র চিকিৎসকদের যুক্তি, আন্দোলনের চাপে সরকার যদি কলকাতা পুলিশের কমিশনার, ডিসি (নর্থ), দুই সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যকর্তাকে সরিয়ে দেয়, তা হলে সেটা মেনে জুনিয়রদেরও এ বার কাজে ফেরা উচিত।
তাঁদের প্রশ্ন, এত দিন সাধারণ মানুষের যে সীমাহীন সমর্থন পাওয়া গিয়েছে, কাজে না-ফিরলে তা কি আর সে ভাবে পাওয়া যাবে? উল্লেখ্য, সোমবার রাতে জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে বৈঠকের পরে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চার কর্তাকে অপসারণের কথা ঘোষণা করেন। কিন্তু, তার পরেও জুনিয়র ডাক্তাররা জানান, তাঁরা কর্মবিরতি চালিয়ে যাবেন।
এর আগে স্বাস্থ্যভবনের সামনে গভীর রাতেও প্রায় হাজার কয়েক সাধারণ মানুষকে দেখা গিয়েছে। কাকতালীয় ভাবে সোমবার রাতে খানিকটা ফাঁকাই ছিল সেই এলাকা। আজ, বৃহস্পতিবার মেডিক্যাল কাউন্সিল অভিযানের ডাকও দেওয়া হয়েছে। যে অ্যাসোসিয়েশনের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ, তার সমর্থক এক চিকিৎসকের পাল্টা দাবি, ‘ঘুঘুর বাসা বানিয়ে রেখেছে। সেটা বদলাতে চাওয়া কি অপরাধ? গত বছরেও কাউন্সিলের নির্বাচন হয়। গণনার সময়ে আমরাই ২৫০০ ভোটে এগিয়ে ছিলাম। কিন্তু, আচমকাই কাউন্টিং বন্ধ হয়ে যায় এবং পরে দেখা যায় রেজাল্ট উল্টে গিয়েছে। এখন ফ্রেশ ভোট হোক। দেখাই যাক না কী হয়।’
তবে তিনিও যে কর্মবিরতি তুলে নিতে চান, তাও জানিয়েছেন এই চিকিৎসক। জানিয়েছেন, নিরাপত্তা নিয়ে সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে কি না তা সাত দিন দেখে আবার না-হয় আন্দোলন শুরু করা যাবে। পাল্টা অভিযোগ, সম্পূর্ণ ‘ভুল’ বোঝানো হচ্ছে আন্দোলনরত ডাক্তারদের। সিনিয়র চিকিৎসকদের একাংশের কথায়, ‘কলকাতা পুলিশ কমিশনারের পদ থেকে দাবি মেনে বিনীত গোয়েলকে সরিয়ে দেওয়ার পরে বলা হচ্ছে, তাঁর নাকি পদোন্নতি হয়েছে। তাঁকে এডিজি এসটিএফ (স্পেশাল টাস্ক ফোর্স) করা হয়েছে। অথচ বাস্তবে, বিনীত সিপি থাকাকালীনই এডিজি র্যাঙ্কে ছিলেন এবং এখনও সেই এডিজি-ই রয়েছেন। উল্টে কলকাতার সিপি পদের যে গ্ল্যামার, তা আর কোনও পদেই নেই। সিপি থেকে যে কোনও পদে যাওয়া মানেই তাই ডিমোশন। একই ভাবে ডিএইচএস (ডিরেক্টর অফ হেলফ সার্ভিস) পদ থেকে সরিয়ে দেবাশিস হালদারকে ওএসডি (অফিসার এন স্পেশাল ডিউটি) করার পরে জুনিয়রদের বোঝানো হচ্ছে, সেটাও নাকি পদোন্নতি।’
যে সংগঠনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেই অ্যাসোসিয়েশন অফ হেলথ সার্ভিস ডক্টরস-এর সাধারণ সম্পাদক উৎপল বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাল্টা বক্তব্য, ‘সিপিএমের সঙ্গে আমাদের তো কোনও সম্পর্কই নেই!’ কর্মবিরতি তুলে নেওয়া প্রসঙ্গে তাঁর অভিযোগ, ডাক্তারদের সব দাবি তো সরকার মেনে নেয়নি! পদ থেকে যাঁদের সরানো হয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে তো বিভাগীয় তদন্ত করা উচিত ছিল।
রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিবকেও সরানো হয়নি। থ্রেট কালচারের অবসান হয়নি। তা হলে কি আপনারা কর্মবিরতি চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে? উৎপলের জবাব, ‘জুনিয়র ডাক্তররা খুব পরিণত। ওঁরা যা সিদ্ধান্ত নেবেন, আমরা তার সঙ্গে থাকব।’