লড়াইয়ের শরিক মা-বাবা, তবু শঙ্কায় অনিকেত-কিঞ্জলদের পরিবার
এই সময় | ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪
আরজি কর কাণ্ড প্রকাশ্যে আসার পরের দিন সেখানকার অ্যানাটমি বিল্ডিংয়ের সামনে জড়ো হয়ে কয়েকজন জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলন শুরু করেন। মুখে ছিল বাঁধাবুলি, ‘জাস্টিস ফর আরজি কর।’ আন্দোলনের সেই স্রোত এবং তার কারিগরদের দিকে তাঁকিয়ে রাজ্যের মানুষ। আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের অনেকেরই শিকড় জড়িয়ে জেলার সঙ্গে। টেলিভিশন চ্যানেল, খবরের কাগজে মুখ দেখে ছেলে, মেয়ের জন্য পরিবারের লোকেদের গর্ব হয়। তবে ‘রাজ-রোষে’-এ পড়ার ভয় পাচ্ছেন মা-বাবারাও। হাজার হোক, সন্তান বলে কথা!আন্দোলনের সামনের সারিতে থাকা দেবাশিস হালদার মাধ্যমিকে রাজ্যে অষ্টম, উচ্চমাধ্যমিকে একাদশ হয়েছিলেন। আঁকা,আবৃতি প্রতিযোগিতাতেও প্রথম স্থানে থাকতেন তিনি। নাটক, অভিনয়েও দক্ষ। আন্দোলনে কিঞ্জল নন্দ, অনিকেত মাহাতো, রুমেলিকা কুমারদের সঙ্গে মুখ হয়ে ওঠেন হুগলির বলাগড়ের খামারগাছির দেবাশিস। দেবাশিসের গ্রামের বাড়িতে থাকেন মা অনিমা, বাবা ক্ষিতীশ ও পিসি মীরা। বাবা সামান্য একটি গুমটি দোকান চালিয়ে ছেলেকে পড়াশোনা করিয়েছেন। পরে পূর্ত দপ্তরে গ্রুপ-ডি পদে চাকরি করে অবসর নেন।
ছেলের কী খবর? সংবাদমাধ্যমের প্রশ্ন শুনেই চোখের জল মুছে অনিমা বলেন, ‘ছেলের ন্যায়, বিচারের জন্য আন্দোলন করছে এটা খুব ভালো লাগছে। ছোট থেকে প্রতিবাদী না হলেও কখনও মিথ্যার আশ্রয় নিতো না। ছেলের কেরিয়ার নিয়ে ভয় লাগে। আবার এটা ভেবে সাহস জাগে সিনিয়ার ডাক্তাররা ওঁর পাশে রয়েছে। তরুণী চিকিৎসককে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে।মা হিসেবে তার ন্যায্য বিচার চাই।’
ছেলের প্রতিবাদী মুখ দেখে গর্বে চোখে জল আসে অনিকেতের বাবা-মায়ের। ছোট থেকেই ছেলে অন্যায় দেখলে সহ্য করতে পারে না, প্রতিবাদ করা তাঁর অভ্যাস। জানাচ্ছে আন্দোলনের অন্যতম মুখ ঝাড়গ্রাম জেলার শিলদার বাসিন্দা অনিকেত মাহাতোর পরিবার। অনিকেতের বাবা অপূর্ব কুমার মাহাতো অবসরপ্রাপ্ত ফার্মাসিস্ট। মা তারারানি মাহাতো গৃহবধূ।
অপূর্ব বলেন, ‘ছেলে ছোট থেকেই প্রতিবাদী। অন্যায় সহ্য করতে পারত না। স্কুলের পরীক্ষায় তাঁর অঙ্কের খাতায় ৯৮ নম্বরের এর জায়গায় ৩৪ নম্বর ভুল করে দেওয়া হয়েছিল। ছেলে আমাকে নিয়ে সোজা হাজির হয়েছিল প্রধান শিক্ষকের কাছে। অঙ্কের শিক্ষক উত্তরপত্র পুনরায় দেখে নম্বর ঠিক করে দেন। ওর ভুল ছিল না।’ তারারানী মাহাতো বলেন, ‘কোনও অন্যায় হলে ও নিজেকে আটকে রাখতে পারে না।’ তাঁরা দু'জনেই বলেন, ‘ছেলে ঠিক করছে। একটু পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে। তাই একটু ভয়ও হয়।’
আন্দোলনের সামনের সারিতে ওঠে এসেছেন পূর্ব মেদিনীপুর জেলার এগরার এরেন্দা গ্রামের বাসিন্দা কিঞ্জল নন্দও। ছেলেবেলা গ্রামে কাটলেও বাবার চাকরিসূত্রে পরে কলকাতাতেই বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন কিঞ্জল। তাঁর বাবা পেশায় শিক্ষক। গ্রামের বাড়িতে দেখা মিলল তাঁর কাকা দেবব্রত নন্দর সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘আমিও একজন চিকিৎসক। ভাইপো আন্দোলনে রাজ্যের মুখ হয়ে উঠেছে দেখে বেশ ভালো লাগছে। আমি ওঁর সঙ্গে কয়েকবার আন্দোলন মঞ্চে গিয়ে দেখা করেছি। ছোট থেকেই প্রতিবাদী ছিল।’ ঠাকুমা কিরণময়ী নন্দ বলেন, ‘আমরা ওকে পুপুন নামে ডাকি। ছোট থেকেই পড়াশোনায় ভালো।’
অনিকেত, দেবাশিস, কিঞ্জল একা নন, এরকম বহু ছেলে-মেয়ে আজ আন্দোলনে জড়িয়েছেন। তাঁদের সকলকে এক সুতোয় গেঁথেছে অভয়ার নির্মম মৃত্যুর বিচারের দাবি। তাঁদের বিশ্বাস, এই আন্দোলনই তাঁদের ন্যায্য বিচার এবং দাবি পাইয়ে দেবে।