টাকা না দিলে ফেল করিয়ে দেওয়া হবে পরীক্ষায়। তালে তাল না মেলালে ইন্টার্নশিপ শেষ হলেও মিলবে না ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ বা এনওসি। অন্তত তিন হাজার টাকা নজরানা না দিলে স্নাতকোত্তরের থিসিস অনুমোদনই পাবে না এথিক্স কমিটিতে। এমবিবিএস পাস করেও ১৫-৩০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে না পারলে রেজিস্ট্রেশন মিলবে না মেডিক্যাল কাউন্সিল থেকে।কার ওপর কখন যে কোপ নেমে আসবে, তা জানেন না ডাক্তারি পড়ুয়া থেকে শুরু করে জুনিয়র ডাক্তাররা! ফলে নিজের শিক্ষাঙ্গনেই তটস্থ হয়ে থাকতে হয় সকলকে। অভিযোগ, তথাকথিত ‘উত্তরবঙ্গ লবি’র ঘনিষ্ঠ কিছু চিকিৎসকের ধমকানি, চমকানিতেই এমন বেনজির হয়রানির শিকার হতে হয় পড়ুয়াদের একাংশকে।
কারণ, ওই চিকিৎসকরাই আদতে কর্তৃপক্ষ অথবা মেডিক্যাল কলেজের শীর্ষস্থানীয় কর্তা অথবা ফ্যাকাল্টি কিংবা প্রভাবশালী হাউসস্টাফ বা সিনিয়র রেসিডেন্ট। এঁদের জন্যই রাজ্যের প্রায় সব মেডিক্যাল কলেজে বজায় রয়েছে ভয়ভীতির পরিবেশ। সেই থ্রেট কালচারের অবসান চাওয়াও তাই আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারদের অন্যতম প্রধান দাবি।
এই থ্রেট সিন্ডিকেট চলে যাঁদের কাঁধে ভর করে, তেমনই ১২০ জন সরকারি চিকিৎসকের তালিকা তৈরি করে জনমত তৈরির চেষ্টা করছেন জুনিয়র ডাক্তাররা। সেই তালিকায় একেবারে উপরের দিকেই রয়েছেন আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ, প্রাক্তন উপাধ্যক্ষ সঞ্জয় বশিষ্ঠ, প্রাক্তন ডিন বুলবুল মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে বর্ধমান মেডিক্যালের বিরূপাক্ষ বিশ্বাস, এসএসকেএমের অভীক দে ও রণজিৎ সাহা, আরজি করের সৌত্রিক রায়, সৌরভ পাল, আশিস পাণ্ডে-সহ অনেকে।
জুনিয়র ডাক্তারদের বক্তব্য, মাত্র আটটি মেডিক্যাল কলেজের ওই ১২০ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না-হলে তাঁদের কর্মবিরতি তোলাটা মুশকিল। বর্ধমান মেডিক্যালের এক শিক্ষক-চিকিৎসক বলছেন, ‘শুধু জুনিয়র ডাক্তাররাই নন, কখনও কখনও এই থ্রেট সিন্ডিকেটের কোপে পড়েন সিনিয়র ডাক্তাররাও। মনে আছে, উত্তরবঙ্গ লবির ঘনিষ্ঠ এক চিকিৎসকের জন্য এক অ্যাসোসিয়েট প্রফেসরকে প্রায় রাতারাতি থিসিসের সিনপসিস লেখানো হয়েছিল শিয়রে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় বসার ছিল বলে। ওই স্নাতকোত্তর পড়ুয়ার মুরোদ নেই বলে তাঁর হয়ে গাইডই লিখে দিয়েছিলেন গোটা থিসিসটাই।’
উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালের এক সিনিয়র ফ্যাকাল্টি জানাচ্ছেন, ক্ষমতাসীন লবির ঘনিষ্ঠ ডাক্তারি পড়ুয়া যদি খারাপ নম্বরও পান, তাঁর নম্বর বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য বিরাট চাপ থাকে উপরমহলের একাংশের। তা না-মানলে অপছন্দের বদলি একপ্রকার অনিবার্য। জুনিয়র ডাক্তারদের বক্তব্য, এই থ্রেট সিন্ডিকেটে যে শুধুমাত্র মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসকরা রয়েছেন তা-ই নয়। রয়েছেন রাজ্য স্বাস্থ্যবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের কর্তারাও।
এমনকী, সরকারি চিকিৎসক নন, অথচ লবির বলে প্রভাবশালী, এমন চিকিৎসকও রয়েছে তালিকায়। কোভিড পর্ব থেকেই তাঁদের সবচেয়ে বেশি বাড়বাড়ন্ত দেখা গিয়েছে। এঁদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে, বাস্তবে তা চাক্ষুষ না করা পর্যন্ত জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতি তোলাটা ঝুঁকির। কারণ, কাজে যোগ দেওয়ার পরে আন্দোলনকারীদের উপর কোপ পড়াটাই ভবিতব্য।
জুনিয়র ডক্টর্স ফ্রন্টের নেতা অনিকেত মাহাতোর কথায়, ‘কয়েক জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, ঠিকই। কিন্তু থ্রেট সিন্ডিকেটের অধিকাংশ সদস্য বহাল তবিয়তে ঘুরছেন এখনও। তাঁদের প্রশাসনিক দায়িত্ব থেকে না-তাড়ালে সুস্থ ভাবে কাজ করা অসম্ভব।’ আন্দোলনকারীরা জানাচ্ছেন, সরকার এঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করলেই বাদবাকি মেডিক্যাল কলেজের থ্রেট সিন্ডিকেটের সদস্যের নামও তাঁদের তরফে জানানো হবে।
আপাতত তাঁরা সব মেডিক্যাল কলেজে ছাত্র নির্বাচন চাইছেন। কারণ, এখন কোনও কলেজেই কোনও নির্বাচিত ছাত্র সংসদ বা স্টুডেন্টস ইউনিয়ন নেই। ফলে ক্ষমতাসীন লবির ঘনিষ্ঠ চিকিৎসক ও ডাক্তারি পড়ুয়াদের নিয়ে তৈরি স্টুডেন্টস ইউনিট-ই ছড়ি ঘোরায় সব কলেজে।