সল্টলেকের এ-কে ব্লকের বাসিন্দা সুতপা মৌলিক গৃহবধূ। ৫০ বছরের জীবনে এই প্রথম লাগাতার নানা মিছিল-মিটিং-জমায়েতে যাচ্ছেন। ১৪ অগস্টের রাত দখল থেকে জীবনের এই নতুন পর্বের সূচনা। কখনও স্কুলের প্রাক্তনীদের মিছিলে, কখনও স্বাস্থ্য ভবনে জুনিয়র ডাক্তারদের ধর্নায়, কখনও আবার মহামিছিলে থেকেছেন অচেনা-অজানা সঙ্গীদের সঙ্গে।উত্তরপাড়ার মধ্য ৪০-এর গৃহবধূ সমাপ্তি ঘোষও তেমনই। জানাচ্ছেন, প্রায় ২০ বছর বৈবাহিক জীবনের আগে টাইপিংয়ের চাকরি করতেন। বিয়ের পরে ছাড়তে হয় চাকরি। জীবন বাধা পড়ে যায় বাড়ি সংলগ্ন সাড়ে তিন কিলোমিটারের মধ্যে। তার মধ্যেই দোকান-বাজার, বাপের বাড়িও। রাত দখলের রাত সেই সাড়ে তিন কিলোমিটারের পরিধি বাড়িয়ে দিয়েছে। সমাপ্তি এখন শ্যামবাজার, সল্টলেক সেক্টর ফাইভের মিছিলে যাচ্ছেন।
সুতপার কথায়, ‘মেয়ে হয়ে জন্মানো মানেই কখনও বাবার অধীন, কখনও স্বামীর অধীনে থাকার চল, সেটা কেন? আমি ভাগ্যবান। বাবা অথবা স্বামীর থেকে এ কথা কখনও শুনতে হয়নি। কিন্তু বহু চেনা মেয়ের জীবন বাধা পড়েছে নিয়মের এই বেড়াজালে।’ তবে কি এই প্রতিটি মিছিল-মিটিং থেকে পুরুষতন্ত্রের বেড়াজালকেও অলক্ষ্যে ভাঙতে চাইছেন সুতপা-সমাপ্তিরা? ভাঙার আওয়াজ যে উঠছে, তা নিয়ে তাঁরা নিঃসন্দিহান। তাঁদের মতে, কতটা ভাঙা পড়বে তা সময়ই বলবে।
১৪ অগস্টের প্রথম রাত দখল, তারপরে যাবতীয় মিছিল, মিটিং, জমায়েত, প্রতিবাদে সামনের সারিতে রয়েছেন মেয়েরা। শুধু তো ছাত্রী বা কর্মরতা মহিলারাই নন, আরজি কর হাসপাতালে ধর্ষণ-খুনের বিচার চেয়ে রাস্তায় নেমেছেন সুতপা-সমাপ্তিদের মতো ছা-পোষা ঘরের গৃহিণীরাও। সাধারণত যাঁরা আবদ্ধ থাকেন বা থাকতে বাধ্য হন চার দেওয়ালের মধ্যেই।
আর এই আবহেই উঠছে প্রশ্ন, রাজপথে জনস্রোতের অন্তরালে ফল্গুর মতোই কি বয়ে যাচ্ছে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধ-চোরাস্রোত? পুরুষের দাপাদাপি, ছড়ি ঘোরানোর চিরাচরিত প্রবণতার পরিবর্তনের সূচনা কি করে দিল রাত-দখলের ডাক? প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক সুকন্যা সর্বাধিকারী আশাবাদী, এই অভূতপূর্ব গণ আন্দোলন ও তাতে মহিলাদের উজ্জ্বল উপস্থিতি সুদুরপ্রসারী প্রভাব অবশ্যই ফেলবে। এমনকী পুরুষের মধ্যেও তা ইতিমধ্যে ছাপ ফেলতে শুরু করেছে।
বাড়ি থেকে আপত্তি উঠছে না? সমাপ্তির কথায়, ‘আরজি করের ঘটনার পরে নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া অনেকগুলো ঘটনাকে আমি যেন কানেক্ট করতে পারছি। মেয়ে মানেই তাকে চার দেওয়ালের মধ্যে থাকতে হবে! এ জিনিস আর মানবো না।’ সুতপার বড় মেয়ে চাকরি সূত্রে ইউএসএ-তে। ছোট মেয়ে সদ্য কলেজে ভর্তি হয়েছেন। মেয়ের মা হিসেবেই তিনি নামছেন পথে। জীবনে কখনও রাজনীতি করেনওনি।
পরিচালক-নাট্য ব্যক্তিত্ব সুমন মুখোপাধ্যায়ের মতে, রাজনীতির মূলস্রোতকে সরিয়ে রাখা এই আন্দোলনের মূল স্বর জাস্টিসের জন্য হলেও আরও নানা আনুষঙ্গিক দাবি উঠে আসছে। বহুস্বর আর বহু অভিমুখের এই আন্দোলন সমাজের এক সার্বিক পরিবর্তনের বার্তা অবশ্যই দিচ্ছে। সুমনের সঙ্গে সহমত অভিনেত্রী চৈতি ঘোষালও। তাঁর বক্তব্য, ‘এই আন্দোলন থেকে একটা সুরক্ষিত সমাজেরও দাবি উঠছে। কর্মক্ষেত্র হোক বা বাড়ি — সর্বত্র মেয়েদের জন্য, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য এমনকী পুরুষদের জন্যও একটা সুরক্ষা দরকার।’
যে নবীন রক্তকে এখন মিছিলের অগ্রভাগে দেখা যাচ্ছে, চোখে-চোখ রেখে যাঁরা সমানে লড়ে যাচ্ছেন থ্রেট-কালচার, দুর্নীতির বিরুদ্ধে, তাঁদের মনেও চিরাচরিত পুরুষতন্ত্র সেরকম প্রভাব ফেলবে না বলেই মনে করছেন সাহিত্যিক তিলোত্তমা মজুমদার।
খানিকটা ভিন্ন সুরও রয়েছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন স্টাডিজ়ের অধ্যাপক ঐশিকা চক্রবর্তীর বক্তব্যে। তাঁর বক্তব্য, পুরুষতন্ত্রের আগল ভেঙে যাচ্ছে বলতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু যখন ‘পুলিশ তুমি চিন্তা করো, তোমার মেয়েও হচ্ছে বড়’ বলে স্লোগান ওঠে, চুড়ি পরে বসে থাকার কথা বলা হয়, তখন আশঙ্কা হয়, মনের গভীরে প্রোথিত দীর্ঘদিনের পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব কি সত্যিই বদলাবে?
সুকন্যার অবশ্য দাবি, ইতিমধ্যেই তা বদলাতে শুরু করেছে। উদাহরণ দিয়ে বলছেন, ‘আমরা মেয়েবেলা থেকেই পুরুষের কু-দৃষ্টির শিকার। আগে রাস্তাঘাটে বেরোলে এই কু-দৃষ্টির মুখোমুখি হলে আমি চোখ নামিয়ে নিতাম। একটা সময়ে কু-দৃষ্টির বিরুদ্ধে আমিও চোখ দেখাতাম। উল্টোদিকের চোখটা আগে নামত না। এখন কিন্তু নামছে।’