• মুর্শিদাবাদের এই মন্দিরে কয়েকশো বছর ধরে একসঙ্গে হয় তিনটি দুর্গা প্রতিমার পুজো
    আজকাল | ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • আজকাল ওয়েবডেস্ক:‌ মুর্শিদাবাদের নবগ্রাম থানার পাশলা গ্রামের রায় এবং রায়চৌধুরী পরিবার প্রাচীন ঐতিহ্যকে বজায় রেখে আজও একটি মন্দিরে একসঙ্গে তিনটি দুর্গা প্রতিমার পুজো করেন। যা দেখতে প্রতি বছর ভিড় জমান জেলার নানা প্রান্তের অসংখ্য মানুষ।

    গ্রামের প্রাচীন ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, প্রায় ২৫০ বছর আগে মুর্শিদাবাদের দহপাড়া অঞ্চলে বাস করতেন ‘‌রায়’‌ পরিবারের সদস্য শশীকান্ত রায়। একদা তিনি মা কালীর আশীর্বাদ লাভের আশায় কামাখ্যাতে সাধনা করার জন্য পাড়ি দেন। তাঁর পরিবারের সদস্যরা বিশ্বাস করেন, সেখানেই শশীকান্তের সঙ্গে পরিচয় হয় তন্ত্রসাধিকা কুন্ডলা মায়ের। কিছুদিনের মধ্যেই কুণ্ডলা মা এবং শশীকান্তের মধ্যে গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তারপর তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে একত্রে বসবাস করার সিদ্ধান্ত নেন।

    রায় পরিবারের সদস্যদের কথায় উঠে আসে তৎকালীন সময়ের একটি আশ্চর্য কাহিনী। তাদের মতে, শশীকান্ত যখন দহপাড়ায় নিজের গ্রামে ফিরে আসছিলেন সেই সময় তিনি গঙ্গার ধারে একটি পাথরের দুর্গা মূর্তি পড়ে থাকতে দেখেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই শশীকান্ত রায় মা দুর্গার স্বপ্নাদেশ পান। দেবী তাঁকে আদেশ দেন, যাত্রা পথে তৃতীয় দিন তিনি যেখানে পৌছবেন সেখানেই যেন সেই দুর্গা মূর্তি স্থাপন করা হয়।

    দেবীর আদেশ অনুযায়ী সেই দুর্গা মূর্তি কোলে নিয়েই গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হন শশীকান্ত ও তার স্ত্রী কুন্ডলা মা। কিন্তু তৃতীয় দিন পাশলা গ্রামে গম্ভীরা নদীর পাড় দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় সেই পাথরের দুর্গা মূর্তি এতটাই ভারী হয়ে ওঠে যে তা কোলে নিয়ে হাঁটা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তখন তারা সেই দুর্গা মূর্তি নামিয়ে রাখেন এবং সেখানেই শুরু হয় মা দুর্গার পুজো।

    রায় পরিবারের ইতিহাস ঘাঁটলে আরও জানা যায়, শশীকান্ত রায়ের এই পুজোর কথা যখন নবাব আলীবর্দী খাঁ জানতে পারেন তখন তিনি শশীকান্তকে ১৬০টি গ্রাম উপহার দেন এবং আদেশ দেন সেখানকার গ্রামবাসীদের কাছ থেকে কর বাবদ যে টাকা আদায় করা হবে তা দিয়ে তিনি যেন এই পুজো সম্পন্ন করেন। এভাবেই শশীকান্ত ধীরে ধীরে অঞ্চলের জমিদার হয়ে ওঠেন এবং একটি বিশাল দুর্গা মন্দির স্থাপন করে জাঁকজমক সহকারে সেখানে দুর্গাপুজো শুরু করেন।

    পরবর্তীকালে ওই গ্রামে কৃষ্ণচন্দ্র এবং গিরিশ (অনেকে মনে করেন এই দু’‌জন শশীকান্তের কাকার ছেলে) নামে দুই ব্যক্তি শশীকান্তের পুজোর পাশাপাশি নিজেদের মতো করে দুটি আলাদা দুর্গাপুজো শুরু করেন। পরবর্তীকালে একই মন্দিরের মধ্যে তিনটি আলাদা আলাদা মূর্তি তৈরি করে পুজো শুরু হয়। বর্তমানে ‘‌মা বুড়ি’‌ নামে খ্যাত মূল পুজোর দায়িত্বে রয়েছে রায়চৌধুরী পরিবার। শশীকান্তের শুরু করা পুজোর দায়িত্ব সামলাচ্ছেন তাঁর বংশধর প্রশান্ত রায়। মণ্ডপের বাম পাশে অবস্থিত প্রতিমার পুজোর দায়িত্ব রয়েছে অখিল রায়চৌধুরীর হাতে।

    রায়চৌধুরী পরিবারের সদস্য শৌভিক রায়চৌধুরী বলেন, ‘‌দীর্ঘদিনের রীতি মেনে এখনও একই মন্দিরে তিনটি দুর্গা মূর্তি তৈরি করে দেবীর আরাধনা করা হয়। এমনকি আগে যে জাঁকজমকের সঙ্গে এই পুজো হত তাতেও কোনওরকম ছেদ পড়েনি।’‌ পুরনো ঐতিহ্য মেনেই শশীকান্তের পরিবারের দুর্গামূর্তি রাখা হয় একেবারে মাঝখানে। বাকি দুটি প্রতিমা দুই পাশে থাকে। ডান পাশের দুর্গা প্রতিমা ‘‌মা বুড়ি’‌ নামে গ্রামে খ্যাত।

    শৌভিকবাবু বলেন, ‘‌নিয়ম মেনে ষষ্ঠীর দিন ভোরবেলা তিনটি পরিবার নিকটবর্তী দীঘিতে কলসিতে জল ভরতে যান। প্রথমে ‘‌মা বুড়ি’‌র জন্য জল নেওয়া হলে বাকি দু’‌টি প্রতিমার জন্য জল নেওয়া হয়। সন্ধিপুজোর সময় হাজার খানেক পরিবার হাঁড়িতে করে ‘‌মা বুড়ি’‌র কাছে ভোগ নিবেদন করেন। পুজো শেষে পরিবারের মহিলারা সেই প্রসাদ খেয়ে তাঁদের উপোস ভাঙেন।’‌ পুরানো রীতি মেনে আজও এখানে পঞ্চমুন্ডির আসনে বসে পুজো করেন প্রধান পুরোহিত। দেবীর উদ্দেশ্যে বলিদান প্রথা এখনও চালু রয়েছে এখানে। পুজো উপলক্ষ্যে গ্রামে বসে বিশাল মেলা। হাজার হাজার লোক আসেন প্রতিমা এবং মেলা দেখার জন্য। দশমীর দিন কাঁধে করে বেহারারা তিনটি প্রতিমা নিরঞ্জনের জন্য নিয়ে যান। স্থানীয় ডিহি দীঘিতে ‘‌মা বুড়ি’‌ প্রতিমা নিরঞ্জনের পর একে একে নিরঞ্জন হয় বাকি দুটি প্রতিমা।
  • Link to this news (আজকাল)