‘চোখ বুজে থাকার পাপেই গেল মেয়ে’, নিম্নমানের ওষুুধে প্রাণ গেলেও দায় নেয় না কেউ
আনন্দবাজার | ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪
ডাক্তারের হাত দুটো জড়িয়ে ধরে কলকাতার একটি মেডিক্যাল কলেজের অপারেশন থিয়েটারের প্রৌঢ় কর্মী হাউহাউ করে কেঁদেছিলেন। ‘‘আমাদের চোখ বুজে থাকার পাপেই কি আমার মেয়েটা চলে গেল!’’ সিজ়ার করে সুস্থ সন্তানের জন্ম দিয়ে তাঁর তরতাজা মেয়ে আচমকাই মারা গিয়েছিল। বাড়ির লোককে বলার মতো কোনও যুক্তি ছিল না ডাক্তারের কাছে।
কিন্তু এই মৃত্যুর সঙ্গে ‘চোখ বুজে থাকার পাপের’ যোগটা কী?
স্বাস্থ্য ভবন সূত্রের খবর, ওই হাসপাতালের একাধিক স্ত্রী-রোগ চিকিৎসক দলবদ্ধ ভাবে স্বাস্থ্যকর্তাদের জানিয়েছিলেন, মাসের পর মাস যে ওষুধ সরবরাহ হচ্ছে, তার মান ‘ভয়াবহ’। চোখের সামনে তাঁরা দেখছেন, আচমকাই রোগীর অবস্থার অবনতি হচ্ছে। তার পর কোনও কিছু বোঝার সুযোগ না দিয়েই মৃত্যু। তাঁরা স্বাস্থ্যকর্তাদের জানান, কোনও একটি জায়গায় নয়, বিভিন্ন হাসপাতালে বেশ কিছু রোগীর ক্ষেত্রে এমন হচ্ছে। তাঁদের অনুমান, কোনও ওষুধের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কারণেই
এমন বিপর্যয়।
স্বাস্থ্য ভবন এ নিয়ে বৈঠক ডাকে। তদন্ত কমিটিও হয়। এক চিকিৎসক বলেন, “আমরা, ডাক্তাররা অনেকেই দলবদ্ধ হয়ে অভিযোগ করেছিলাম অক্সিটোসিনের মান নিয়ে। প্রসবের ক্ষেত্রে জরায়ু সঙ্কোচনের জন্য অক্সিটোসিন অত্যন্ত জরুরি ওষুধ। স্বাভাবিক প্রসবে এই ইনজেকশন ইন্ট্রামাস্কুলার দেওয়া হয়। আর সিজ়ারের ক্ষেত্রে দেওয়া হয় ইন্ট্রাভেনাস। দেখেছিলাম, সিজ়ারের ক্ষেত্রেই সমস্যা বেশি হচ্ছে।”
কিন্তু স্বাস্থ্য ভবন থেকে জানানো হয়, ওষুধের ওই নমুনা পরীক্ষা হয়েছে, কিন্তু কোনও সমস্যা ধরা পড়েনি, তাই আশঙ্কা অমূলক। হাসপাতাল সূত্রে খবর, চিকিৎসকেরা আর কথা না বাড়িয়ে নিজেরা উদ্যোগী হয়ে কিছু দিন ওই ওষুধ বন্ধ রেখে বিকল্প ব্যবস্থা করেছিলেন। তাতে মৃত্যু কমানো গিয়েছিল। তার পর আবার সেই ওষুধ। আবার মাঝেমধ্যেই বিপর্যয়।
আসল চমক অপেক্ষা করছিল এর পরে। উত্তর ২৪ পরগনার এক হাসপাতালে এক প্রসূতির এমন আচমকা মৃত্যুর পর পরিবারের তরফে চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ জানানো হয় পুলিশে। দেহের ময়না তদন্ত হয়। কিন্তু ময়না তদন্তে বিশেষ কিছু উঠে আসেনি। এর পর কিডনির হিস্টো-প্যাথোলজি পরীক্ষা করে দেখা যায়, কিডনি বিকল হয়ে গিয়েছিল ওই তরুণীর। ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ জানান, ওষুধের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কারণেই এমন ঘটেছে। স্বাস্থ্য ভবনকে সে কথা জানানো হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের স্বাস্থ্য কর্তারা মৃদু তিরস্কার করে বলেন, ‘অযথা উত্তেজনা ছড়াবেন না।’
কলকাতার ওই মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক বলছিলেন, ‘‘এই ব্যবস্থায় টিকে থাকতে হবে জানি, তাই আমরাও চোখ বুজে থাকা অভ্যাস করেছি। ডাক্তার, নার্স, অপারেশন থিয়েটারের কর্মী সবাই জানি, যে কোনও মুহূর্তে বিপদ আসতে পারে। কিন্তু সবাই নির্বিকার থাকি। এরই মধ্যে আমাদের এক সহকর্মীর মেয়ের মৃত্যু হয়। নিজের মেয়েকে হারিয়ে চোখ বুজে থাকার পাপের কথা মনে হয়েছিল ওঁর।’’ অভিযোগ, এ রাজ্যের বর্তমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এখন চোখ বুজে থাকা আর দায় ঠেলাঠেলি করাটাই দস্তুর। যেমন, সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোর্স জানিয়েছে, অক্সিটোসিনের বিষয়ে তাদের কিছু করার নেই। ২০১৪ সালের পর থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে কর্নাটকের একটি সংস্থাই সারা দেশে ওই ওষুধ সরবরাহ করে। রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের ডেপুটি ডিরেক্টর (সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোর্স) প্রশান্ত বিশ্বাস বলেন, “এই ধরনের ওষুধের ক্ষেত্রে খুব বেশি সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। বাইরের রাজ্য থেকে আনার সময় কোল্ড চেন অর্থাৎ নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রাখা, নির্দিষ্ট হাসপাতালে তা পৌঁছনোর পরে সেখানকার স্টোরে ঠিক ভাবে রাখা, ওয়ার্ডে ওষুধ পৌঁছনোর পরেও সেই সাবধানতা অবলম্বন করা, প্রত্যেকটা ধাপে এগুলো মানতে হয়। সব ক্ষেত্রে কি সেটা হয়?” তাঁর মন্তব্য, “শুধু সিএমএস-এর উপরে দায় চাপালে হবে না। নিজেদের দায়িত্বও পালন করতে হবে হাসপাতালগুলিকে।”
অক্সিটোসিনের ক্ষেত্রে তিনি দাবি করছেন, তাঁদের দায় নেই। কিন্তু অন্য ওষুধ, ফ্লুইড ইত্যাদির ক্ষেত্রে যে অহরহ মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, সে ক্ষেত্রে কী বলবেন তিনি? প্রশান্তবাবুর জবাব, “অভিযোগ পেলে নমুনা পরীক্ষা হয়, মান খারাপ থাকলে সংস্থাকে বাতিল করা হয়।”
কিন্তু সেই সংস্থা কী ভাবে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় উতরে গেল, কাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তারা সরকারি হাসপাতালে ওষুধ সরবরাহের গুরুদায়িত্ব পেল, সেটা তদন্ত করে দেখা হয় কি? এই প্রশ্নের নির্দিষ্ট উত্তর পাওয়া যায়নি। তবে ওষুধের টেন্ডার প্রক্রিয়ার বিস্তারিত নিয়মকানুনের কথা ব্যাখ্যা করেছেন তিনি।
কিন্তু নিয়ম যেমন থাকে, তার ফাঁকও তো থাকে। সেই ফাঁক গলে যারা ঢুকে পড়ছে, তাদের ক্ষেত্রে কী করা হয়? যেখানে প্রতিনিয়ত সরকারি হাসপাতাল থেকে ওষুধের মান এবং কার্যকারিতা নিয়ে অজস্র অভিযোগ আসছে, সেখানে কতগুলি ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেন তাঁরা? ডেপুটি ডিরেক্টর বলেন, “আমরা যত নমুনা পরীক্ষা করি, তার দুই থেকে তিন শতাংশের মান খারাপ ধরা পড়ে। সেগুলোকে বাতিল করা হয়।” এই পর্বতপ্রমাণ অভিযোগের সামনে এই দুই থেকে তিন শতাংশের রিপোর্ট খারাপ আসা কি যথাযথ বলে মনে হয়? তাঁর উত্তর, “মান নিয়ে শুধু অভিযোগ করলেই তো হবে না। প্রমাণ দিতে হবে। অনেক হাসপাতাল ওষুধ নেওয়ার দু’মাস পরে নমুনা পরীক্ষা করতে পাঠায়। তত দিনে তারা সেই ওষুধ ব্যবহার করতে শুরু করে দিয়েছে। সেই ওষুধে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হলে দায় কার? পরীক্ষার রিপোর্ট আসতে আসতে তো অনেক রোগীর শরীরে সেই ওষুধ চলে গেছে।” আর স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণ স্বরূপ নিগম বলেছেন, “দায় সকলের। সকলকেই সতর্ক হতে হবে।”
আসল কথা হল, স্বাস্থ্য দফতরে কার্যত কোনও বিষয়েই কারও কোনও দায় নির্দিষ্ট করা নেই। তাই যেখানে মানুষের জীবনের প্রশ্ন জড়িত, সেখানেও নিয়ম মানা হচ্ছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব আদতে কারও উপরেই বর্তায় না। প্রাক্তন স্বাস্থ্যকর্তারা অবশ্য বলছেন, দায়িত্ব না থাকলেও মুনাফা কিন্তু আছে। কোটি টাকা উড়ে বেড়াচ্ছে স্বাস্থ্যে। কোভিডের সময় থেকে এই টাকা বিভিন্ন জায়গায় লুটে নেওয়া শুরু হয়েছে। অভিযোগ, সন্দীপ ঘোষের ঘনিষ্ঠ চিকিৎসক অভীক দে-র এক সময়ের ঘাঁটি বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে এই টাকা নয়ছয় হয়েছে মাত্রাছাড়া। অভিযোগ, মাইক্রো-বায়োলজির এক চিকিৎসককে রীতিমতো হুমকি দিয়ে বলা হয়, কোভিড পরীক্ষার কয়েকশো কিট নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তিনি আপত্তি তোলায় তাঁকে অন্যত্র বদলি করে দেওয়া হয়। এখানেই শেষ নয়, শারীরিক নিগ্রহও চালানোর চেষ্টা হয়েছিল ওই মহিলা চিকিৎসকের উপরে। তিনি আনন্দবাজারকে বলেন, “হাসপাতালে সরবরাহ হওয়া কিট কোভিডের সময়ে বাইরে বিক্রি হয়েছে, সে কথা জানতে পেরেছিলাম। অভিযোগ করেও লাভ হয়নি।” ওই মেডিক্যাল কলেজেরই ল্যাবরেটরির এক কর্মী বলেন, “এক দিকে পরীক্ষা না করে রোগীদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে, অথচ সেই পরীক্ষার কিটই বিক্রি হয়েছে বাইরের ল্যাবরেটরিতে। মানুষের জীবন নিয়ে ব্যবসা হতে দেখেছি চোখের সামনে।”
সেই ব্যবসা কি এখনও বন্ধ হয়েছে? জানা যাচ্ছে, কিছু মেডিক্যাল কলেজের সেন্ট্রাল ল্যাবরেটরিতে নিখরচায় কিছু পরীক্ষানিরীক্ষার যন্ত্র দিয়েছে প্রস্তুতকারী সংস্থা। মন্ত্রী এসে ফিতে কেটেছেন। সংস্থার ‘কর্পোরেট সোশাল রেসপনসিবিলিটি’ নিয়ে জয়ধ্বনি উঠেছে। তার পরে কী দেখা যাচ্ছে? স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তার দাবি, “পরীক্ষার জন্য যে রি-এজেন্ট প্রয়োজন হয়, তা তো ওই সংস্থাই তৈরি করে! তাই তাদের থেকেই তা কেনা হচ্ছে। দামি রি-এজেন্ট কিনতে কিনতে অল্প দিনেই উঠে আসছে যন্ত্রের দাম।”
এখানেই শেষ নয়। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, সংস্থা জানিয়ে দিয়েছে, শুধু যন্ত্র নয়, কোনও কোনও জায়গায় তারা টেকনিশিয়ানও দেবে। সেটাও নিখরচায়। অভিযোগ, সেই টেকনিশিয়ানরা এসে ঝড়ের গতিতে কাজ চালাচ্ছেন। রাতারাতি পরীক্ষার সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে। বাড়ছে রি-এজেন্টের ব্যবহার। অভিযোগ, কোনও নজরদারি না থাকায় রোগীর তালিকায় ঢুকছে অজস্র ‘ভুতুড়ে’ নাম। শুধুই সংস্থা করছে এগুলো?
কলকাতার একটি মেডিক্যাল কলেজের এক আধিকারিক বলেন, “সর্ষের মধ্যে ভূত না থাকলে এই সব দুর্নীতি কখনও মাসের পর মাস চলতে পারে?” তাঁর অভিযোগ, “স্বাস্থ্য দফতর, সংশ্লিষ্ট সংস্থা, সিএমএস, হাসপাতালের কর্মীদের একাংশ মিলে এ এক বড় চক্র।” অতি সম্প্রতি কলকাতার একটি মেডিক্যাল কলেজে লাভের বখরা নিয়ে বিস্তর গোলমাল হয়। তখনই বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। দেখা যায়, যে অসহায় গরিব রোগীদের দ্রুত পরীক্ষা প্রয়োজন, তাঁরা হা-পিত্যেশ করে বসে আছেন, আর কিছু অস্তিত্বহীন নামের ‘পরীক্ষা’ হয়ে চলেছে প্রতিদিন।
দেখার দায় কার? স্বাস্থ্যসচিব আগেই বলে দিয়েছেন,“দায় সকলের।”