বাংলাদেশ পরিস্থিতিই কি বাড়াল চাপ? তাতেই কি সীমান্ত এলাকায় জমি জোগাড়ে এল গতি—জমি জটে দীর্ঘ সময় ধরে আটকে থাকা বাংলাদেশ সীমান্ত সুরক্ষার কাজে রাজ্য সরকারের সাম্প্রতিক তৎপরতায় এই চর্চাই শুরু হয়েছে প্রশাসনের অন্দরে।
অতীতে কেন্দ্র-রাজ্যের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা চলেছে। টানাপড়েন, দোষারোপ আর পাল্টা দোষারোপের ঘটনাও ঘটেছে হামেশাই। কিন্তু বাংলাদেশ-সীমান্ত সুরক্ষিত করতে প্রয়োজনীয় জমি পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ তুলে এসেছে কেন্দ্র এবং সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। প্রশাসনের অন্দরের খবর, জমি জোগাড়ের জট কাটাতে কার্যত নিঃশব্দেই তৎপর হয়েছে নবান্নের সর্বোচ্চ মহল। মন্ত্রিসভার নানা বৈঠকে বিধি পাশ করিয়ে জমি কিনে তা সীমান্ত সুরক্ষার জন্য দেওয়ার অনুমতি একাধিক জেলা প্রশাসনকে ইতিমধ্যেই পাঠিয়েছে নবান্ন। পাশাপাশি, সীমান্তবর্তী কোন জেলায় জমি-জট কী পরিস্থিতিতে রয়েছে, তারও রিপোর্ট চেয়েছে নবান্ন। ঘটনাচক্রে, এটা এমন সময়ে হয়েছে, যখন বাংলাদেশে ক্ষমতার বদল ঘটেছে নাটকীয় ভাবে। সে দেশের জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে বা পালিয়ে গিয়েছে বহু জঙ্গি-নেতা। সূত্রের দাবি, তার পরে এ রাজ্যের সঙ্গেও পরিস্থিতি নিয়ে সবিস্তার আলোচনা করেছে কেন্দ্র। কারণ, অবস্থানগত ভাবে ভারত–বাংলাদেশের মধ্যে এ রাজ্যের অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রাক্তন এক আমলার কথায়, “বাংলাদেশের পরিস্থিতি যা, তাতে এই পদক্ষেপ জরুরি ছিল। অনেকগুলি দেশের সীমান্ত এ রাজ্যের সঙ্গে রয়েছে। ফলে বিস্ফোরক, জাল অর্থের প্রবেশ থেকে জঙ্গি অনুপ্রবেশ— সব প্রশ্নেই সীমান্তে স্থায়ী পরিকাঠামো জরুরি।” এ প্রসঙ্গে এক কর্তা বলেন, “এমন সমস্যা বাড়লে নিয়মিত এনআইএ বা এনএসজি-র আনাগোনা বাড়বে রাজ্যে। তাতে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে। ফলে দ্রুত পদক্ষেপ করার নির্দেশ রয়েছে।”
প্রশাসনিক সূত্র জানাচ্ছে, দু’টি পদ্ধতিতে এমন ক্ষেত্রে জমি নেওয়া হয়ে থাকে। এক, সরাসরি ক্রয় করা। তাতে জমির বাজারদর নির্ধারণ করে, তার সঙ্গে ৫০% উৎসাহ-দর বা ‘সোলেশিয়াম’ নির্দিষ্ট হয়। তবে এ ক্ষেত্রে মন্ত্রিসভার সম্মতি লাগে। খুব সম্প্রতি সেই অনুমতিই আংশিক ভাবে পেতে শুরু করেছে সীমান্তবর্তী জেলা প্রশাসনগুলি। এক কর্তার কথায়, “এই ক্ষেত্রের বহু পরিমাণ জমির অনুমোদন বকেয়া ছিল। সেটাই এখন পাওয়া যাচ্ছে। তা ছাড়া যে অনুমোদনগুলি মন্ত্রিসভা দিয়ে রেখেছে, তার দ্রুত বাস্তবায়নে জোর দেওয়া হচ্ছে।” দুই, সরকারি জমি বিএসএফ-কে হস্তান্তর করার পদ্ধতি। তাতে এখনও নবান্নের শীর্ষমহলের অনুমোদন পাওয়া যায়নি বলেই সংশ্লিষ্ট মহলের দাবি। এক কর্তার দাবি, “জমির মানচিত্রের সঙ্গে নির্ধারিত এলাকা মিলিয়ে সিপিডব্লিউডি বা অন্য কোনও সরকারি সংস্থাকে দিয়ে জমির সমীক্ষা করায় বিএসএফ। সেটা অনেক জায়গায় এখনও বাকি রয়েছে।” তাঁর সংযোজন, “কয়েকটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় আইন অনুযায়ী জমি অধিগ্রহণ হয়। তবে এ ক্ষেত্রে রাজ্যের সরাসরি ক্রয়ের নীতিই মানতে হচ্ছে।”
সংশ্লিষ্ট মহল জানাচ্ছে, ইতিমধ্যেই জেলা প্রশাসনগুলির থেকে রাজ্য জানতে চেয়েছে— মন্ত্রিসভার অনুমোদন এবং টাকা বরাদ্দের পরেও কত জমি প্লট করা হয়নি, মন্ত্রিসভার অনুমোদনের অপেক্ষায় কত জমি রয়েছে অথবা যৌথ সমীক্ষা না হওয়ায় মন্ত্রিসভার অনুমোদনের জন্য প্রস্তাবই করা যায়নি, আর কত পরিমাণ জমির মালিকের সঙ্গে কথা বলে সীমানা নির্ধারণ বা তার দর স্থির হয়নি ইত্যাদি।
প্রশাসনিক সূত্র জানাচ্ছে, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে প্রায় ৪০৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত এলাকা রয়েছে। তার মধ্যে অসমে ২৬২, ত্রিপুরায় ৮৫৬, মিজ়োরামে ৩১৮, মেঘালয়ে ৪৪৩ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে সে দেশের সঙ্গে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত এলাকার দৈর্ঘ্য প্রায় ২২১৭ কিলোমিটার। কেন্দ্র ওই সীমান্ত এলাকায় কাঁটাতারের সুরক্ষা দিতে দীর্ঘদিন ধরেই রাজ্য সরকারের থেকে জমি চাইছে। কিন্তু জমি অধিগ্রহণ এ রাজ্যের নীতিতে না থাকায় (মালিকের থেকে সরাসরি জমি কেনাই রাজ্যের নীতি) সেই কাজ এগোচ্ছিল কার্যত শম্বুকগতিতে। অতীতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ বা বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে একাধিক বৈঠকও হয়েছিল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। কিন্তু জমি জোগাড়ে গতি আসেনি। এত দিনে প্রায় ১৬৪৫ কিলোমিটার সীমান্তে কাঁটাতার দেওয়া গিয়েছে। প্রায় ৪৩৫ কিলোমিটার এলাকায় কাঁটাতার দেওয়া বাকি। গত বছরের শেষে সুপ্রিম কোর্টের একটি মামলার শুনানিতে সরাসরি এ রাজ্য সরকারের এমন ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল কেন্দ্রও।