• আটপৌরে রূপে দেবী পুজো নেন অব্রাহ্মণের হাত থেকে
    বর্তমান | ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • অতিজিৎ চৌধুরী, চুঁচুড়া: গ্রামের নাম পলাশী। ঩সিরাজদৌল্লার পলাশী নয়। এই পলাশীর পরিচিতি গ্রামের সুপ্রাচীন ‘পতিদুর্গা’কে ঘিরে। ঠিক কত বছরের দুর্গা তা কোথাও লেখা নেই। কেউ বলেন, বর্তমান সময় থেকে ন’পুরুষ আগে পুজো শুরু হয়েছিল। কেউ কেউ হিসেব কষেও উঠতে পারেন না। হিসেবের ভুলভুলাইয়া থেকেও আকর্ষক তথ্য, হুগলির ধনেখালির গ্রামটিতে আর একটিও দুর্গাপুজো হয় না। ক্লাব ও পুজো সংস্কৃতির রমরমার মরশুমেও হয় না। গ্রামের দুর্গাপুজো মানেই ‘পতিদুর্গা’র মণ্ডপে শুধু হইচই। 


    হুগলির এক্কেবারে শেষপ্রান্তে পলাশী। বাংলার ১৩৪৮ সালের আশ্বিন মাসেও ছিল ঘনজঙ্গল। গা ছমছম নানা কাহিনি প্রচলিত। তেমনই আকর্ষক ‘পতিদুর্গা’, গঠনে আর পুজোর প্রণালীতে, এমনকি পুরোহিতেও। দেবী, শিবের সঙ্গে একাসনে বসে আছেন। শিবদুর্গার এহেন মূর্তি বিরল নয়। কিন্তু সঙ্গে আছে আরও অনেককিছু যা এই দুর্গাকে বিশেষ করেছে। তিনি দশভূজা নন, মহিষাসুর সংহারকও নন। আটপৌরে দেবীর সঙ্গে তাঁর ছেলেমেয়ে কেউ নেই। শিবের সঙ্গে আছেন নন্দী আর দুর্গার সঙ্গে জয়া। শিবের পদতলে আছে ষাঁড় আর দুর্গার পদতলে সিংহ। এমন রূপের কারণেই হয়তো তাঁর নাম, ‘পতিদুর্গা’। গ্রামীণ পতিব্রতাদের জন্যই হয়ত এমনতর রূপে দেবীর আরধনার পথ খুঁজেছিলেন কোনও রাজা বা জমিদার। তবে সে ইতিহাস আজ গ্রামের পরিচিতির মতোই অপরিচিত।


    পুজো হয় শাক্তমতে। কিন্তু পুজো কোনও ব্রাহ্মণ করেন না। সেই আদিযুগ থেকে ‘পতিদুর্গা’র পুজোর পুরোহিত নিম্নবর্গের মানুষ। বংশ পরস্পরায় একজন চর্মকার সম্প্রদায়ের মানুষ ‘পতিদুর্গা’র পুজোর পৌরহিত্য করে আসছেন। বর্তমান পুরোহিত উত্তম পণ্ডিত। তিনি বলেন, ‘আমি পুজো করছি ৩০ বছর ধরে। আমরা হাড়ি সম্প্রদায়ের মানুষ। প্রায় আট পুরুষ আগে আমাদের পরিবারের এক পুরুষ পুজোর দায়িত্ব পেয়েছিলেন।’ এই পুজোতে আদিবাসী সহ নানা নিম্নবর্ণের মানুষ আসেন। জৈষ্ঠ মাসের সেই বিশেষ পুজোতেই কেবল ব্রাহ্মণ থাকেন। সেই নিরিখেও এই পুজো বিরল। গ্রামের সাবেক বাসিন্দা দিলীপ পাল বলেন, ‘পতিদুর্গা ছাড়া গ্রামে আর কোনও পুজো কখনও হয়নি। পুজোর বয়স নিয়ে শুধু একটি তথ্য আছে। ১৩৪৮ সালে মন্দির সংস্কার করা হয়েছিল। আর বছর কুড়ি আগে একবার দেবীমূর্তিকে পাথরের করে তোলা হয়েছিল। এক রাতে কেউ তা ভেঙে দিয়ে যায়। তারপর আর কখনও মূর্তিকে মাটি ছাড়া অন্য উপকরণে তৈরি করা হয়নি।’


    এখনও গ্রামে চর্চিত সেই ঘটনা। যেমন চর্চিত দেবীর জাগ্রত হওয়ার কথা। থিমের দাপটের যুগে দুর্গার নানা রূপ নিয়ে আলোচনা অসীম। নানা বনেদি পুজো নিয়েও জনশ্রুতির মেলা। অথচ হুগলির অন্তিমপ্রান্তবাসী এক গ্রামীণ দুর্গা তাঁর মাটির গন্ধমাখা নামের মতোই চর্চার অন্তরালে থেকে গিয়েছেন।
  • Link to this news (বর্তমান)