রাজ্য জুড়ে ‘থ্রেট কালচারের’ বিরুদ্ধে সম্প্রতি আয়োজিত এক প্রতিবাদ সভা। সভামঞ্চ আলো করে বসে সিনিয়র, অবসরপ্রাপ্ত এক সরকারি চিকিৎসক। তাঁকে দেখে দর্শকাসনে থাকা ডাক্তারদের একাংশের চোখের সামনে ফ্ল্যাশ ব্যাকে ফুটে উঠল দু’দশক পুরোনো ছবি।তখন সদ্য তৈরি হয়েছে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ। তৎকালীন বাম সরকার সিদ্ধান্ত নিল, সেখানে এবং এসএসকেএমে ক্যাপিটেশন ফি নিয়ে পড়ুয়া ভর্তি হবে। সরকারি হাসপাতালে এ ভাবে টাকা নিয়ে ভর্তির বিরুদ্ধে গর্জে উঠল ছাত্র সমাজ। শুরু হলো আন্দোলন। অভিযোগ, সেই আন্দোলনকে দমাতে যে ছাত্রনেতারা তৎপর হয়ে উঠেছিলেন, সাম্প্রতিক সভামঞ্চে থাকা ওই অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসক তাঁদেরই একজন!
ক্যাপিটেশন ফি-এর বিরুদ্ধে সেই আন্দোলন আজকের মতোই গড়িয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত। মুখ পুড়েছিল বাম-সরকারের। আর তার রাগ গিয়ে পড়েছিল আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারদের উপরে। সে সময়ে একদিন আরজি কর হাসপাতালেই রোগী-মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। অভিযোগ, সেই ভাঙচুরের ঘটনায় কার্যত ফাঁসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল আন্দোলনরত ওই পড়ুয়াদের কয়েকজনকে। এখন থ্রেট-কালচারের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা চিকিৎসক-নেতা ও অন্যদের নেতৃত্বেই তো ঘটেছিল সে সব। সে দিনও কলকাতা হাইকোর্ট কড়া অবস্থান নেওয়ায় বেঁচে যান আন্দোলনরতরা।
‘থ্রেট কালচার’ — আরজি করের ঘটনার পরে শব্দবন্ধটি বেশ ছড়িয়েছে চারপাশে। এর বিরুদ্ধে আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারদের পাশে দাঁড়িয়েছেন বহু সিনিয়র চিকিৎসক, যাঁরাই এক সময়ে ছিলেন কাঠগড়য়। এখন আন্দোলরতদের একাংশের দাবি, ‘এই থ্রেট কালচারের জন্ম বাম আমলেই। এর অজস্র উদাহরণ রয়েছে। নয়ের দশক থেকে বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে জুনিয়র ডাক্তারদের উপরে চলত অত্যাচার, র্যাগিং। সে সময়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা ভোগ করা ছাত্রনেতারাই থ্রেট কালচারের সূচনা করেছিলেন।’
অভিযোগ, বর্তমান সভামঞ্চের ওই সিনিয়র চিকিৎসক যখন ছাত্রনেতা ছিলেন, তখন প্রোমোশন-পোস্টিংয়ের জন্য তাঁর সামনে কার্যত হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকতেন তৎকালীন সিনিয়র প্রফেসর চিকিৎসকরাও! অভিযোগ, ছবিটা বদলায়নি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে শুধু মুখগুলো।
ফিরে দেখা যাক পিছনে। সময়টা নয়ের দশকের শেষ দিক। আরজি কর হস্টেলের মানিকতলা মেসে থেকেই পড়াশোনা করতেন বড় অংশের পড়ুয়া। খুব কম ডাক্তারি পড়ুয়া বাইরে কোথাও ঘর ভাড়া করে থাকতেন। কলকাতার বাসিন্দাদের কয়েকজনের কথা আলাদা। তা ছাড়া, বেশিরভাগ পড়ুয়াই গ্রামের নিম্নবিত্ত পরিবারের। সে সময়ের একটি ঘটনা স্মৃতি হাতড়ে তুলে এনেছেন এক সিনিয়র চিকিৎসক। জানিয়েছেন, সে সময়ে মানিকতলা মেসে কে খাবেন, কে খাবেন না, তা ঠিক করতেন এক ছাত্রনেতা। নিয়মিত মেসে টাকা দেওয়া হলেও নেতাদের অনুমতি ছাড়া খাবার টেবিলে বসার ‘অনুমতি’ ছিল না।
সিনিয়র এক চিকিৎসকের কথায়, ‘একবার হস্টেলে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ছবিতে মালা দিতে গিয়ে হুমকির মুখে পড়েছিলেন জুনিয়ররা। আর হাসপাতালে জুনিয়ররা যখন ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে আন্দোলনে নামেন, তখন মেরে হাত ভেঙে দেওয়ারও ঘটনা ঘটেছে।’ যাঁর নেতৃত্বে হাত ভাঙা, এখনকার প্রতিবাদের মিছিলে দেখা গিয়েছে তাঁকেও। তিনি এখন একটি জেলার স্বাস্থ্য দপ্তরের অন্যতম উচ্চপদস্থ কর্তা।
বাঁকুড়া, বর্ধমান-সহ রাজ্যের অন্যত্র থাকা মেডিক্যাল কলেজেও তখন ‘থ্রেট কালচারের’ রমরমা ছিল বলে অভিযোগ। বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজের এক প্রাক্তনীর কথায়, ‘পড়াশোনার সময়েই তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর জনসভায় যেতে হতো। না গেলে মারধরও করা হয়েছে। লরি ভাড়া করে জেলার অন্যত্র আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এর প্রতিবাদে ১৯৯১-এ বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজে অ-রাজনৈতিক ইউনিয়ন তৈরি হয়।’ সে দিন ‘থ্রেট কালচার’ আমদানি করা চিকিৎসকদের একাংশকে আজ মিছিলে হাঁটতে দেখে তাই মুচকি হাসছেন অনেকেই।