অপছন্দদের নম্বর কমানো আর পছন্দের পড়ুয়ার নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া — দেখতে দেখতে একদিন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায় কোচবিহারের এমজেএন মেডিক্যাল কলেজের ফরেন্সিক মেডিসিন বিভাগের এক অ্যাসোসিয়েট প্রফেসরের। সতীর্থ, সহকর্মী ও সিনিয়রদের বারণ না-মেনেই গত বছরে প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন তিনি। সরব হন কলেজ কর্তাদের অনিয়মের বিরুদ্ধেও। তখনই প্রমাদ গুনেছিলেন অনেকে।কোচবিহারের বাসিন্দা ওই প্রফেসরের ‘পানিশমেন্ট’ ট্রান্সফারের অর্ডার বেরোতে বেশি সময় লাগেনি। বদলি হয়েছিলেন কলকাতার এসএসকেএমে। সতীর্থ-সহকর্মীরা মনে অসন্তোষ চেপে মুখে কুলুপ আঁটেন। অন্যায় দেখেও এ ভাবে নিশ্চুপে মেনে নেওয়াকে অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছেন বহু ফ্যাকাল্টিই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজের জেনারেল সার্জারি বিভাগের এক শিক্ষক-চিকিৎসকের অভিযোগ, টেনেটুনে পাশ করা পড়ুয়ারাও যাতে অনার্স পান, সেই মতো নম্বর দিতে নিয়মিত চাপ আসে। ‘অনুরোধ’ না-মানলে পানিশমেন্ট ট্রান্সফার একপ্রকার অনিবার্য। অনার্সের ‘দাবিদার’ ওই সব ডাক্তারি পড়ুয়ারাই তো ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর কাছে লোক!
প্রফেসরের আক্ষেপ, ‘কাছের লোক নন, এমন পড়ুয়াদের নম্বর কমিয়ে এমনকী ফেল করিয়ে দেওয়ারও চাপ থাকে।’ জুনিয়র ডাক্তাররা জানাচ্ছেন, তবে বেশি নম্বর বা অনার্স পেতে কাঞ্চনমূল্য চোকাতে হয় ‘কাছের পড়ুয়াদের’-ও। পরীক্ষার বিষয়ের ভিত্তিতে যার দাম পেপার প্রতি গড়ে ৫-১৫ হাজার টাকা। অভিযোগ, এই ভয়ভীতির রাজনীতির জাঁতাকলে মাঠে মারা যাচ্ছে অসচ্ছল পরিবারের ছেলে-মেয়েদের কঠোর পরিশ্রমও।
স্বাস্থ্য মহলের বিভিন্ন সূত্রের দাবি, এই জমানায় স্বাস্থ্য-শিক্ষা ক্ষেত্রে ভয়াবহ এই সংস্কৃতি ২০১৬ নাগাদ শুরু হলেও ২০২১ থেকে শুরু হয় তার মারাত্মক রমরমা। স্নাতক বা স্নাতকোত্তর, কোনও কোর্সই এর বাইরে নয়। পরীক্ষা ব্যবস্থার এই অনাচারে জড়িয়ে গিয়েছে রাজ্য স্বাস্থ্যবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের মাথাদের নামও। জড়িত রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের কর্তাদের একাংশও।
অভিযোগ, বিরূপাক্ষ বিশ্বাস, অভীক দে-র মতো কিছু ‘ভুঁইফোড়’ নেতা বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে এই চক্র চালাচ্ছেন। আর তাঁদের মাথায় বসে আস্কারা দিয়ে যাচ্ছেন দাদা-দিদিরা। এই তালিকায় উঠে এসেছে একাধিক মেডিক্যাল কলেজের রোগীকল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান তথা রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের সভাপতি সুদীপ্ত রায়, স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুহৃতা পাল, আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ ও প্রাক্তন উপাধ্যক্ষ সঞ্জয় বশিষ্ট এবং আরও কয়েক জনের নাম। জুনিয়র ডাক্তারদের অভিযোগ, রাজ্যজুড়ে চলা এই চক্রে ‘কিংপিন’-এর তালিকায় রয়েছেন মোট ১৩ জন। থ্রেট সিন্ডিকেটের তালিকার একেবারে উপরের দিকেও রয়েছে এঁদের নাম।
সুদীপ্ত সব অভিযোগই অস্বীকার করে বলেছেন, ‘আমি চক্রান্তের শিকার। অপদস্থ করতে সব অভিযোগের সঙ্গে আমার নাম জড়িয়ে দিচ্ছে একাংশ। তদন্তে সব সত্য একদিন প্রকাশ পাবে। সিবিআই ও আদালতের উপর আমার ভরসা আছে।’ সুহৃতা ও সঞ্জয়ের সঙ্গে বহু চেষ্টাতেও ফোন ও মেসেজের মাধ্যমে যোগাযোগ করা যায়নি বলে তাঁদের প্রতিক্রিয়া মেলেনি। আর সন্দীপ তো জেলে।
জুনিয়র ডাক্তারদের কথায় একের পর এক বিস্ফোরক অভিযোগ উঠে এসেছে। আরজি করের এক অর্থোপেডিক স্নাতকোত্তর ছাত্রের অভিযোগ, মেডিক্যাল কাউন্সিলের এক সদস্য তাঁকে হুমকি দেন। বলেন, টাকা না-দিলে এবং তাঁদের আজ্ঞাবহ না-হলে, এমএস (অর্থো) পাশ করার পরেও তা রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের রেকর্ডে নথিভুক্ত করা হবে না। ফলে তিনি অর্থোপেডিক সার্জেন হিসেবে রোগীও দেখতে পারবেন না। প্রথমে বিরোধিতা করলেও পরে একপ্রকার বাধ্য হয়েই তাঁকে টাকা দিতে হয়। জানাচ্ছেন, বাকিদের ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হয়নি।
দাপুটে এই ‘দাদা’দের বিরোধিতার রাস্তায় হাঁটার অর্থ, সংঘাত অনিবার্য। মেডিক্যাল কলেজ, স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কাউন্সিল — সর্বত্র একই ছবি। ইন্টার্নশিপের পর ডাক্তারির রেজিস্ট্রেশন পাওয়ার ক্ষেত্রেও মেনে চলতে হয় ‘দাদা’দের কথা। বর্ধমানের মেডিসিনের স্নাতকোত্তর পড়ুয়া বলছেন, ‘থিসিসের সিনপসিস লিখে সেটাকে এথিক্স কমিটিতে পাশ করাতে টাকা লাগে। পরীক্ষার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই থিসিস জমা করতেও টাকা লাগে। টাকা না দিলে কিংবা তর্কাতর্কিতে গেলে পরীক্ষার নম্বরে তার প্রভাব পড়তে বাধ্য। কে-ই বা নিজের কেরিয়ার নিয়ে ঝুঁকি নেবে? তাই অধিকাংশই মেনে নেয় সব কিছু।’
বিভিন্ন কলেজ মিলিয়ে শতাধিক সিনিয়র রেসিডেন্ট, হাউসস্টাফ, আরএমও, পিজিটি, ইন্টার্ন এবং ডাক্তারি পড়ুয়ার উপর প্রভাব দেখানোর নানা অভিযোগ প্রাথমিক ভাবে প্রমাণিত হয়েছে। আরজি করে ৫১ জন এবং কল্যাণী জেএনএম হাসপাতালে ৪০ জনের পাশাপাশি বর্ধমান, উত্তরবঙ্গ ও মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের প্রভাবশালীদের কলেজ থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। ডাক্তারদের একাংশের দাবি, এতেই বোঝা যায়, আরজি করের ঘটনার পরে থ্রেট কালচার নিয়ে জুনিয়র ডাক্তারদের এই লাগাতার অভিযোগ পেয়ে সরকারও হাত গুটিয়ে বসে নেই।
তবে এই প্রভাবশালীরারা পুরোনো জায়গায় ফিরলে কি ফের ভয়ের রাজনীতি ফিরে আসবে — প্রশ্নটা ঘুরপাত খাচ্ছে হাসপাতালের অন্দরে। (চলবে)