সংবাদদাতা, কাঁথি: এঁটেল মাটিতে আপেল, কমলালেবু, কফি চাষ করে তাক লাগিয়েছেন এগরার প্রত্যন্ত রসুলপুর-দক্ষিণবাড় গ্রামের প্রগতিশীল কৃষক মাদলকুমার পাল। আপেল সাধারণত লাল ও পাথুরে মাটিতে ফলে। কমলালেবু বেলে-দোঁয়াশ মাটিতে। কফি হয় বেলে-পাথুরে মাটিতে। কিন্তু বুদ্ধির প্রয়োগ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং লেগে থাকার মানসিকতা থাকলে অসাধ্য সাধনও যে করা যায় তা প্রমাণ করে দিয়েছেন মাদলকুমার। এখানেই শেষ নয়, তাঁর বাগানে সারি সারি মাল্টা, মুসুম্বির গাছ শাখা মেলেছে। রয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বহু প্রজাতির ফল-ফুলের গাছ। সবটাই চাষ হচ্ছে কিন্তু জৈব উপায়ে। যেদিকে তাকানো যায় চারদিকে গাছগাছালি আর সবুজের সমারোহ। তার মাঝে বাড়ি মাদলবাবুর। পেশায় তিনি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক। বিকল্প উপায়ে চাষবাস করাই তাঁর নেশা। সেই নেশাই এখন প্রধান পেশা। নিজের বাড়ি সংলগ্ন চার একর জায়গায় চলছে তাঁর কর্মকাণ্ড। এই কর্মকাণ্ডের গুণে তিনি ২০১৩ সালে বর্ধমানের পানাগড়ে মাটি উৎসবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত থেকে কৃষক সম্মান পুরস্কারও পেয়েছিলেন। সেই পুরস্কারই তাঁকে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জুগিয়েছে। শুরু করেছিলেন সামান্য জমিতে চাষবাস করে।
এগরার ভবানীচক বাজার থেকে উত্তরে এক কিলোমিটার গেলেই সর্বোদয় গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন রসুলপুর-দক্ষিণবাড়। বাড়ির সামনে বোর্ডে জ্বলজ্বল করছে ‘কৃষিরত্ন নার্সারি’। আপেল, কমলালেবু, কফি, মাল্টা মুসুম্বি ফলানোর রহস্য কী? মাদলবাবু বলেন, এখানকার মাটি এঁটেল। যাই করি না কেন, আগে যেখানে যেমন মাটি, তার উপযোগী পরিবেশ তৈরি করতে হবে। কমলালেবু চারা লাগানোর জন্য প্রয়োজন উর্বর বেলে-দোঁয়াশ মাটি। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের জৈব সারের সঙ্গে বালিও দিতে হবে। আপেল ও কফি চাষের জন্য মাটির সঙ্গে জৈব সার ও লাল মাটি বা মোরাম মেশাতে হবে। এভাবেই নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সাফল্য ধরা দিয়েছে তাঁর উঠোনে। বাগানের মধ্যেই জৈব সারের বড়সড় ইউনিট করেছেন মাদলবাবু।
এখন মাদলবাবুর বাগানে অন্যতম বাণিজ্যিক ফল মাল্টা মুসুম্বি। চারা লাগানোর দু’ বছরের পর থেকে ফলন শুরু হয়। এক একটির ওজন দু’শ থেকে সাড়ে তিনশো গ্রাম। বছরে তিনশো থেকে পাঁচশোটি মাল্টা ফলে। মাল্টা বেলে-দোঁয়াশ মাটির ফল। তার জন্যও উপযুক্ত মাটি তৈরি প্রয়োজন। আরও আছে। তাঁর বাগানে ৮৫টি প্রজাতির আমগাছ রয়েছে। তার মধ্যে কিছু গাছে সারাবছরই আম ফলে। আটটি জাতের পেয়ারা, পাঁচ জাতের কলা, তিন জাতের লিচু, তিন জাতের বিদেশি কুল রয়েছে। কফির তিনটি গাছ রয়েছে। সেরা কফি চাষি হিসেবে চলতি বছরে জেলা উদ্যানপালন দপ্তরের তরফে পুরস্কারও পেয়েছিলেন। এখন মাদলবাবুর বাগানে ব্ল্যাকবেরি, মালবেরি, চেরি, পেস্তা, থাই কাজু, গোলাপজাম, সাদাজাম কী নেই!
ফুল চাষেও অগ্রণী মাদলবাবু। বাড়ি লাগোয়া জায়গায় বিশালাকার পলি গ্রিন হাউস তৈরি করেছেন। যেখানে বিদেশি জারবেরা সহ বহু ফুলের চাষ হয়। জারবেরা নানা জায়গায় রপ্তানি হয়। শাকসব্জিও জৈব উপায়েই ফলান মাদলবাবু। সেভাবে বাজারমুখোই হন না পরিবারের লোকজন। ধানচাষেও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সাফল্য পেয়েছেন মাদলবাবু। মাদলবাবুর কর্মকাণ্ড দেখে বহু কৃষক উৎসাহিত হন। কৃষকরা এসে হাতেকলমে অনেককিছু শিখে যান। প্রশিক্ষণ শিবিরগুলিতে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়ার জন্য ডাক পড়ে মাদলবাবুর। তাঁর বাগানটিই প্রদর্শনী ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ব্লক সহ কৃষি অধিকর্তা পঞ্চানন ঘোষ বলছেন, মাদলবাবুর কর্মকাণ্ড কৃষকদের কাছে দৃষ্টান্ত। মাদলবাবুর কথায়, সকলে খোঁজে চাকরি। কিন্তু মন দিয়ে উন্নত প্রযুক্তিতে কৃষিকাজ, বাগান করলেই উন্নতি সম্ভব। -নিজস্ব চিত্র