নিজস্ব প্রতিনিধি, রানাঘাট: শান্তিপুরের বড় গোস্বামী বাড়িতে দেবী দুর্গার পুজোয় ব্যতিক্রম হাতে গুণে শেষ করা কঠিন। স্বয়ং অদ্বৈত আচার্যের বংশধরদের বাড়ির পুজো বলে কথা। তার নিজস্বতা থাকবে বৈকি। দশভুজার অস্ত্রবিহীন আটটি হাতের মাতৃমূর্তিই এই বাড়ির মূল আকর্ষণ। কাত্যায়নী রূপে উমার আরাধনায় আজ প্রায় ৩৫০বছর ধরে নিয়োজিত পরিবারের সদস্যরা।
থিমের জৌলুস, চাকচিক্য, আলোর রোশনাই, বিজ্ঞাপন আর বিলবোর্ডের ভিড়ে পুজো কেন্দ্রিক ‘ব্র্যান্ডিং’। বাঙালির সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ দুর্গাপুজো যত বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে ততই ‘সংস্কৃতি’ তার স্থান হারিয়েছে। নামীদামি পুজোকে গ্রাস করেছে কর্পোরেট কালচার। এহেন পরিস্থিতিতে শারদীয়ার প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হিসেবে টিকে রয়েছে অভিজাত বাড়িগুলি। শান্তিপুরে অদ্বৈত আচার্যের উত্তরসূরিদের অন্যতম নিবাস বড় গোস্বামী বাড়ির পুজোয় ঐতিহ্য অটুট রয়েছে। সাড়ে ৩০০ বছর ধরে ন্যূনতম পরিবর্তন না করেই চলছে পূজোর নিয়মকানুন, রীতি।
অদ্বৈত আচার্যের বর্তমান প্রজন্ম হওয়ায় পরিবার বৈষ্ণব। ফলে শাক্তমতের বিপরীত সমস্ত আচার পালন করা হয়। বলি প্রথা কোনওদিনই ছিল না। দেবী দুর্গা এ বাড়িতে কাত্যায়নী রূপে পুজো পান। অবশ্য তার পিছনে রয়েছে পারিবারিক ইতিহাস। বর্তমান প্রজন্মের সত্যনারায়ণ গোস্বামীর কথায়, প্রায় ৩৫০ বছর আগে বাড়ির বিগ্রহ রাধারমন চুরি যায়। কীভাবে ফেরত পাওয়া যায় পরিবারের ইষ্টদেবকে? উত্তর খুঁজতে বিভিন্ন পুরাণ ঘাঁটতে শুরু করেন পরিবারের সদস্যরা। শেষ পর্যন্ত সমাধান মেলে ভগবত পুরাণে। জানা যায়, দেবী কাত্যায়নীর ব্রত করলে বিগ্রহ দেবতাকে পাওয়া যায়। সেইমতো বাড়ির মহিলারা ব্রত নিষ্ঠা সহকারে পালন করা শুরু করেন। ফলও মেলে হাতেনাতে। পরিবারের জ্যৈষ্ঠা বধূ স্বপ্নাদেশ পান, রাধারমনকে খুঁজে পাওয়া যাবে নদীয়ার দিগনগরের একটি দিঘিতে। এরপর দেবী কাত্যায়নীর প্রতি আস্থা কয়েকগুণ বেড়ে যায় তাঁদের। নিয়মিত দুর্গাপুজো শুরু হয়। আজও সেদিনের সেই ঘটনাকে স্মরণ করে পুজোর আয়োজন হয় প্রতিবছর।
তবে ব্যতিক্রমী নিয়ম নীতিগুলির মধ্যে এবাড়িতে দশভুজা দেবী দুর্গা হলেও আটটি হাতে তাঁর কোনও অস্ত্র থাকে না। কেবল দু’টি হাতে অসুর দমনের জন্য অস্ত্র ধরেন দেবী। একচালা প্রতিমায় সপরিবারে বিরাজমান উমা। পরিচিত মূর্তির চেয়ে কিছুটা আলাদা। এখানে কার্তিক এবং গণেশ একে অপরের বিপরীত দিকে অবস্থান করে। যেহেতু গোস্বামীবাড়ির নিজস্ব পুঁথিতে দেবী পূজিতা হন, তাই পরিবারের দীক্ষিত গৃহবধূরাই একমাত্র দেবীর ভোগ রান্না করতে পারেন। পূজোর দিনগুলিতে ৩৩ ব্যাঞ্জনে ভোগ দেওয়া হয়।
আকর্ষণ দশমীতেও! পুজো শেষ হওয়ায় পর ঘট নাড়ানো হয়ে গেলে আর মূর্তি বাড়িতে রাখা হয় না। দশমীতে মন্ত্রমতে বিসর্জন হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মূর্তি বিসজর্ন দিয়ে দেওয়া হয়। তবে এই বিসর্জনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে পারিবারিক পরিগ্রহ রাধারমনও। কারণ দেবীর বিসর্জনের পরই ভোগ নিবেদন করা যায় বিগ্রহ দেবতাকে। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবেই বাংলার সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের অন্যতম মেলবন্ধন রয়েছে বড় গোস্বামী বাড়িতে।