‘ক্লাস করে কী হবে! আমরা আছি তো।’ ‘অ্যাটেন্ডেন্স পারসেন্টেজ আমরা ঠিক করি।’ ‘আমরা আছি, পাশ-ফেল নিয়ে ভাবিস না।’
‘ঠিক ঘর পেয়ে যাবি হস্টেলে। শুধু আমাদের কথা শুনে চলিস।’ ‘যাদের সঙ্গে বলব, তাদের সঙ্গে মিশবি। বাকিদের সঙ্গে মিশলে খারাপ হবে।’কোনওটা বার্তা, কোনওটা পরামর্শ, কোনওটা বা নিখাদ হুমকি। অভিযোগ, নেপথ্যে ক্ষমতাসীন ‘উত্তরবঙ্গ লবি’-র ঘনিষ্ঠরা। সিনিয়র রেসিডেন্ট, আরএমও, হাউসস্টাফ, শিক্ষক-চিকিৎসক এমনকী ইন্টার্ন ও ডাক্তারি পড়ুয়াও রয়েছেন ঘনিষ্ঠদের সেই তালিকায়। মূল টার্গেট — প্রথম বর্ষের ডাক্তারির ছাত্রছাত্রীরা। প্রথম রাতেই বেড়াল মারার মতো তাঁদের বুঝিয়ে দেওয়া — হয় সঙ্গে থাকো, নয়তো জাহান্নমে যাও!
এ সমস্যা রাজ্যের প্রায় সব মেডিক্যাল কলেজেই। তবে আরজি কর এবং কল্যাণীর জেএনএম মেডিক্যাল কলেজে তা মাত্রাছাড়া, অভিযোগ জুনিয়র ডাক্তার ও ডাক্তারি পড়ুয়াদের। ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীতে ভিড়ে ডাহা ফেল করা পড়ুয়া সাপ্লিতে শুধু পাশ (৫০% নম্বর) নয়, একেবারে অনার্স (অন্তত ৭৫%) পেয়ে যাচ্ছেন, এমন নজির ভুরি ভুরি। এঁদের মধ্যেই নজর কাড়েন এক-দু’জন। পরবর্তী কালে দোর্দণ্ডপ্রতাপ হয়ে ওঠেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেএনএম-এর এক ইন্টার্ন বলছেন, ‘এই সব দেখে-শুনে ডাক্তারি শেখার ইচ্ছেটাই চলে যায় অনেকের। চোখের সামনে দেখেছি, আমাদের এক সহপাঠী প্রথম বর্ষে অ্যানাটমি, ফিজ়িয়োলজি, বায়োকেমিস্ট্রি — তিনটেতেই ফেল করেছিল। পরে সাপ্লি দিয়ে পাশ করে। দ্বিতীয় বর্ষেও দুটো বিষয়ে ফেল করে সাপ্লি দেয়। এর পরেই সে থ্রেট সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়ে এবং টাকা দেয়। তৃতীয় বর্ষে সে-ই দুটো বিষয়ে অনার্স পায় এবং ফাইনাল ইয়ারে ইউনিভার্সিটি টপার হয়!’
আলিম বিশ্বাস নামে ওই ইন্টার্নকে এখন ‘বিজ্ঞাপন’ হিসেবে ব্যবহার করেন থ্রেট সিন্ডিকেটের সদস্যরা। জুনিয়র ডাক্তারদের তৈরি করা থ্রেট সিন্ডিকেটের তালিকায় তাঁর নামও জ্বলজ্বল করছে উপরের দিকেই। ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপে বহু চেষ্টাতেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
একই রকম ‘কেরিয়ার’ গড়ে তোলার অভিযোগ উঠেছে চতুর্থ বর্ষের পড়ুয়া বিচিত্রকান্তি বালার নামেও। তিনিও অনার্স পেয়েছেন ফাইনাল ইয়ারে। তাঁর নামও রয়েছে থ্রেট সিন্ডিকেটের তালিকায়। তাঁর বক্তব্য, ‘কেন আমাকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে, জানি না। কিছুই বুঝতে পারছি না!’ তাঁর দাবি, ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর ‘দাদা’দের সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্ক নেই।
সম্প্রতি তথাকথিত ‘উত্তরবঙ্গ লবি’র ঘনিষ্ঠ এক চিকিৎসককে অধ্যক্ষ পদ থেকে সরিয়ে দেয় ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশন (এনএমসি)। অভিযোগ, তাঁর মদতেই জেএনএম-এ কমিউনিটি মেডিসিনের প্রথম বর্ষের এক পিজিটি-র দাপট চলে। এমবিবিএসের সমাবর্তনে অভীক দে ও বিরূপাক্ষ বিশ্বাসকে সঙ্গে নিয়ে পড়ুয়াদের হাতে ডিগ্রি তুলে দিতে দেখা যায় স্নাতকোত্তর ওই পড়ুয়াকেও! থ্রেট সিন্ডিকেটের তালিকায় থাকা শেখ মহম্মদ অখিল নামের ওই পিজিটি-রও অবশ্য কোনও প্রতিক্রিয়া মেলেনি।
এঁরা সকলেই জেএনএম-এর যে স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার কমিটির সদস্য ছিলেন, সম্প্রতি তা ভেঙে দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। থ্রেট সিন্ডিকেটের সদস্য মোট ৪০ জনকে বহিষ্কারও করা হয়েছে। অভিযোগ, আরজি করে সন্দীপ ঘোষ অধ্যক্ষ থাকাকালীন থ্রেট সিন্ডিকেটের দাদাগিরি ছিল চরমে। সম্প্রতি সেখান থেকেও থ্রেট সিন্ডিকেটের তালিকায় থাকা আরএমও, হাউসস্টাফ, ইন্টার্ন ও ডাক্তারি পড়ুয়া মিলিয়ে দু’দফায় মোট ৫৯ জনকে বহিষ্কার করেছেন আরজি কর কর্তৃপক্ষও।
আরজি করের এক ইন্টার্ন বলেন, ‘এঁরা বলতেন, অপছন্দের ছাত্র-ছাত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে মেরে হাত-পা ভেঙে দেওয়া হবে, পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হবে না, এমনকী ফেল করিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থাও পাকা হবে। বাস্তবে ২০২২-এ সেটাই করে দেখানো হয়। এঁদেরই অঙ্গুলিহেলনে কয়েক জন ভালো ছেলেমেয়ে ফেল করেন। কয়েক জন খারাপ ছেলে অনার্স পান। কয়েক জন পড়ুয়া মারধর খান। এরপর আর কেউ ওঁদের সঙ্গে বিরোধীতা করার সাহস দেখাননি।’
অভিযোগ, ‘দাদা’দের নেকনজরে না-থাকায় আরজি করে গত বছর দু’জন পড়ুয়া ইন্টার্নশিপ শেষ করলেও নো-অবজেকশন সার্টিফিকেট (এনওসি) পর্যন্ত পাননি। ফলে মেডিক্যাল কাউন্সিল থেকে ডাক্তারি রেজিস্ট্রেশন পাওয়াও আটকে যায়। কলকাতা হাইকোর্টের হস্তক্ষেপে ওঁরা এনওসি এবং রেজিস্ট্রেশন পান। অভিযোগ, সবই হতো তৎকালীন অধ্যক্ষের অঙ্গুলিহেলনে। সেই সন্দীপ এখন জেলে। প্রাক্তন উপাধ্যক্ষ সঞ্জয় বশিষ্ঠের সঙ্গেও কোনও ভাবে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।
থ্রেট সিন্ডিকেটের মধ্যে নাম থাকা আরজি করের প্রাক্তন ডিন বুলবুল মুখোপাধ্যায় সব অভিযোগের কথা শুনে বলেন, ‘সরকারি চাকরি করি, সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলবো না।’ ওই মেডিক্যাল কলেজেরই এক ডাক্তারি পড়ুয়া জানাচ্ছেন, কলেজ-ফেস্ট তো ছিলই, ‘দাদা’দের সারা বছর পার্টি-মোচ্ছবও লেগেই থাকত। বছরে অন্তত পাঁচ-সাত বার এর জন্য চাঁদা তোলা হতো। গড়ে ৩-৭ হাজার টাকা চাঁদা পড়ত। প্রথম বর্ষের পড়ুয়া আর ইন্টার্নদের এবং মেয়াদ ফুরিয়ে আসা হাউসস্টাফদের থেকেই সবচেয়ে বেশি চাঁদা আদায় করা হতো। পুরোটাই মনিটর করতেন ‘সন্দীপ স্যর’। (চলবে)