এই সময়, শিলিগুড়ি: এ যেন হূমায়ুন আহমেদের ‘জিন কফিল’ গল্পের সেই লতিফা। যাঁর একের পর এক সন্তানকে খুন করত ‘জিন’। পরে হূমায়ুনের বিখ্যাত চরিত্র, সাইকিয়াট্রিস্ট মিসির আলি রহস্যের জট ছাড়িয়ে জানান, মানসিক বিকারগ্রস্ত লতিফাই তাঁর সন্তানদের খুন করতেন!
শিলিগুড়িতে ২৫ দিনের শিশুকন্যাকে কুয়োয় ফেলে হত্যার অভিযোগ উঠেছে বছর পঁচিশের মা অষ্টমী গোস্বামীর বিরুদ্ধে। তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। উঠে এসেছে হূমায়ুনের লতিফার কথা। অষ্টমীর প্রতিবেশীদের বক্তব্য, গর্ভধারণের পর থেকেই নানা অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করেন ওই তরুণী। মানসিক বিকার থেকেই তিনি শিশুসন্তানকে কুয়োয় ফেলে খুন করেছেন বলে প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান। মঙ্গলবার সকালে শিলিগুড়ির সুকান্তনগরের প্রাণকৃষ্ণ সরণির এই ঘটনায় অষ্টমীকে গ্রেপ্তার করে এ দিনই আদালতে পাঠায় পুলিশ। অভিযুক্ত মাকে জেল হেফাজতে পাঠানো হয়েছে।মর্মান্তিক এই কাণ্ড ঘিরে পরিবারের ভূমিকা নিয়েও গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ, গর্ভধারণের পরে মানসিক সমস্যা দেখা দিলেও তরুণীর চিকিৎসা করাননি পরিজন। উল্টে ঝাড়ফুঁক চলত তাঁর। সময় মতো চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটত না বলেই মত অভিজ্ঞ মহলের। বিজ্ঞানের বদলে এ ধরনের কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে এক দুধের শিশুকে হত্যার ঘটনায় স্তম্ভিত আশপাশের মানুষও।
ঘটনাটা কী? আদতে জলপাইগুড়ির বাসিন্দা অষ্টমীর স্বামী নয়নমণি গোস্বামী শিলিগুড়িতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। স্ত্রীকে নিয়ে সুকান্তনগরে ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। অষ্টমীর প্রসবের পরে দুই পরিবারেরই লোকজন তাঁদের বাড়িতে এসেছিলেন। এ দিন সকালে মেয়েকে পাশে নিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন নয়নমণি। শিশুটির নামকরণও হয়নি এখনও। সাড়ে ১০টা নাগাদ ঘুম ভেঙে দেখেন, বিছানায় মেয়ে নেই। খোঁজ শুরু করেন বাবা।
তখনই অষ্টমী জানান, সন্তানকে বাড়ির কুয়োয় ফেলে দিয়েছেন তিনি। দমকল ও পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। দমকলকর্মীরা পাইপ দিয়ে কুয়োর জল বের করে উদ্ধার করেন শিশুটিকে। ততক্ষণে সে নিথর। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসক মৃত বলে ঘোষণা করেন।
প্রতিবেশীদের থেকে পুলিশ জেনেছে, প্রসবের পরে অষ্টমী নাকি প্রায়ই বলতেন, স্বপ্নে কেউ তাঁকে মেয়েকে কুয়োয় ফেলে দেওয়ার ‘নির্দেশ’ দেন। অষ্টমীর এই ধরনের নানা অসংলগ্ন কথার প্রতিকারে সোমবার রাতভর অষ্টমীকে হনুমান চালিশা শোনানো হয়। ভোরে তাঁকে নাম সংকীর্তন করতে বলা হয়। তিনি যখন নাম সংকীর্তনে বসেন, তখন পরিবারের লোকজন ঘুমোচ্ছিলেন। তারই ফাঁকে অষ্টমী কখন যে শিশুসন্তানকে নিয়ে কুয়োয় ফেলে দেন, তা খেয়াল করেননি কেউই।
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, গর্ভধারণ এবং বিশেষত প্রসবের পরে মায়ের নানা রকম শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের সাইকিয়াট্রির শিক্ষক-চিকিৎসক সৈকত বৈদ্য বলেন, ‘এই সময়ে মায়ের শরীরে অতি দ্রুত নানা হরমোনাল চেঞ্জ হয়। কেউ কেউ এই পরিবর্তনের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেন না। তা থেকে নানা বিচিত্র কাণ্ড ঘটিয়ে বসেন।’ এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত দরকার। তার বদলে অষ্টমীর ঝাড়ফুঁক ও সংকীর্তনে পরিস্থিতি ক্রমেই হাতের বাইরে বেরিয়ে যায় বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের দার্জিলিং জেলা সম্পাদিকা দেবশ্রী ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমি স্তম্ভিত। ওই মহিলার চিকিৎসার দরকার ছিল। আমরা পুলিশের সঙ্গে কথা বলব। ওই এলাকায় গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গেও আলোচনা করব।’ প্রতিবেশী মায়া সরকার বলেন, ‘শিশুকন্যার মৃত্যুর পুরো দায় ওই পরিবারের।’
এলাকার কাউন্সিলার তথা শিলিগুড়ি পুরসভার মেয়র পারিষদ, তৃণমূল কংগ্রেসের দুলাল দত্তর বক্তব্য, ‘মা মানসিক ভারসাম্যহীন কি না, সেটা পুলিশ তদন্ত করে দেখুক। প্রয়োজনে ওই মহিলার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হোক। এমন ঘটনা তো কোনও ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।’ পরিবারের লোকজন বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলতে চাননি।
জিন কফিল
গল্পের স্থান ধুন্দুলনাড়া গ্রাম। সেখানকার এক মসজিদের ইমাম ও তাঁর স্ত্রী লতিফার একের পর এক সন্তানের মৃত্যু হয়। একটি সন্তান মারা যায় কুয়োয় পড়ে। লতিফা ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলেন ইমাম মুনশি এরতাজউদ্দিনকে। তরুণী ও সুন্দরী লতিফার মনে হতো, কফিল নামে এক জিন তাঁকে ভর করে এবং সন্তানদের মেরে ফেলে। কিন্তু মিসির আলি সব শুনে বোঝেন, গলদ অন্যত্র।
ভালোবেসে বিয়ে করলেও লতিফা আসলে এরতাজউদ্দিনকে তাঁর সামাজিক অবস্থান ও পেশার কারণে ঘৃণাও করেন। সে কারণে নিজেকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্য নিয়ে একের পর এক সন্তানকে হত্যার পথ বেছে নেন। অবশেষে মিসিরের হস্তক্ষেপে শেষ সন্তানটি বেঁচে যায় দম্পতির। লতিফা চোখের জলে কৃতজ্ঞতা জানান মিসিরকে।