ডাক্তারি পড়তে এসে মেধাবি ছাত্রছাত্রীরা গত কয়েক বছরে অবাক হয়ে দেখেছেন, তাঁরা শেখার ইচ্ছে নিয়ে পড়াশোনা করে, পরীক্ষা দিচ্ছেন। আর পাশাপাশি একদল পাশ করছেন স্রেফ বই দেখে টুকে। এঁরাই তো পাশ করে ডাক্তার হবেন! এঁদের হাতে পড়লে কী হাল হবে রোগীদের? প্রশ্নটা কুরে কুরে খেয়েছে পড়াশোনা করতে আসা সহপাঠীদের।অবাক হয়ে তাঁরা লক্ষ্য করেছেন, এমবিবিএস পাঠ্যক্রমে একটা সমান্তরাল পরীক্ষা-ব্যবস্থা চালু রয়েছে। থ্রেট সিন্ডিকেটের ‘দাদা’দের মদতেই চলে গণ-টোকাটুকি। ‘দাদা’দের আবদার মেটাতে গিয়ে আর গণ-টোকাটুকি দেখতে দেখতে অবসাদেরও শিকার হয়েছেন অনেকে। উঠে এসেছে আত্মহত্যার নজিরও!
২০২৩-এর ১২ জুন। কোচবিহারের এমজেএন মেডিক্যাল কলেজে গলায় কাপড় পেঁচিয়ে সিলিং থেকে ঝুলে গিয়েছিলেন বর্ধমান পুলিশ লাইনের নিরীহ মেধাবী ছাত্রী স্নিগ্ধা। মঙ্গলবার ফোনে তাঁর বাবা প্রণবকুমার কুণ্ডু বলেন, ‘প্রথম বর্ষের পরীক্ষায় ওর চেয়ে কম মেধাবীদের টোকাটুকির বহর দেখে ভেঙে পড়েছিল। ওর মনে হয়েছিল, যদি ডাক্তারিটাই না-শেখা হয়, তা হলে এত পরিশ্রম করে তিন বারের চেষ্টায় নিট পরীক্ষার গণ্ডি টপকে এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি হয়ে লাভটা কী হলো?’ প্রণবের দাবি, স্নিগ্ধা বার বারই বলতেন, মন ভালো নেই, ভালো লাগতো না কোচবিহার মেডিক্যালের সংস্কৃতিও।
ক্লাস শেষের পরে সিনিয়র ‘দাদা’রা অহেতুক প্রথম বর্ষের পড়ুয়াদের ডেকে তাঁদের ঘরে বসিয়ে রাখত। সেই র্যাগিংয়ের প্রথাকেও মেনে নিতে পারেননি তাঁর মেয়ে, দাবি প্রণবের। স্নিগ্ধা গল্প করত, ‘দাদা’রা বলতেন, পড়াশোনা নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলবে। শুধু ওঁদের দলে থাকতে হবে। পরীক্ষায় পাশ করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব ওঁদের।
প্রণবের কথায়, ‘আমি বলেছিলাম, হস্টেলে থাকতে হবে না। কাছেই কোনও বাড়ি ভাড়া করে দেবো। কিন্তু তার আগেই মেয়ে চলে গেল! আমি সবটা জানিয়েছিলাম কর্তৃপক্ষকে। আমাকে বলা হয়েছিল, লিখিত অভিযোগ করতে। কিন্তু আমি আর তা করিনি। মেয়ে তো আর ফিরে আসবে না!’
বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, স্নিগ্ধার মতো পরিণতি না-হলেও, থ্রেট সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে, হবু-ডাক্তারদের মধ্যেও সীমাহীন অবক্ষয় দেখে বহু ছাত্রছাত্রীই অবসাদে ডুবে যান। চিকিৎসক তৈরির পাঠশালায় সদ্য এমবিবিএস উত্তীর্ণ কিংবা পড়ুয়াদের একাংশের অমানুষিক আচরণকে মন থেকে মেনে নিতে পারেন না শিক্ষিত যুবক-যুবতীরা।
গত বৃহস্পতিবারই কল্যাণীর জেএনএম মেডিক্যাল কলেজের এক্সটেন্ডেড কলেজ কাউন্সিল মিটিংয়ে তৃতীয় বর্ষের এক ছাত্রী অভিযোগ করেন, ‘দাদা’দের ‘অন্যায়’ আবদার অমান্য করার পরে যাতে কোপে পড়তে না-হয়, তার জন্য শুধু তিনি নন, তাঁর বাবা-মাও কার্যত পায়ে ধরেছিলেন থ্রেট সিন্ডিকেটের সদস্য ইন্টার্ন ও পিজিটি-দের। ডাক্তারি পড়ুয়াদের একাংশের দাবি, এমন ছবি আদৌ বিরল নয়।
কোচবিহার মেডিক্যালে থ্রেট সিন্ডিকেটকে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে প্রাক্তন উপাধ্যক্ষ তথা সুপার রাজীব প্রসাদের দিকে। সংবাদমাধ্যম থেকে ফোন শুনেই তা কেটে দেওয়ায় এবং মেসেজের কোনও জবাব না দেওয়ায় তাঁর কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। নানা অনিয়মের অভিযোগে সম্প্রতি তাঁকে যাবতীয় প্রশাসনিক দায়িত্ব থেকে সরিয়ে বদলি করা হয়েছে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজও অবশ্য মুক্ত নয় থ্রেট সিন্ডিকেটের দাপট থেকে।
ওই কলেজের জেনারেল সার্জারির এক শিক্ষক-চিকিৎসকের কথায়, ‘টেনেটুনে পাশ করা ছাত্রকে অনার্স নম্বর দেওয়ার চাপ ছিল। বাধ্য হয়ে করে দিয়েছি। নইলে ওদের অত্যাচার সইতে হবে।’ কেমন অত্যাচার? শিক্ষক-চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, বদলির ভয় তো আছেই। পাশাপাশি রয়েছে আর্নড লিভ স্যাংশন না হওয়া, বিদেশযাত্রার অনুমোদন না পাওয়া, এমনকী নানা প্রশাসনিক ফাইল স্বাস্থ্য দপ্তর পর্যন্ত না-পৌঁছনোর হুমকি।
এসএসকেএমের এক ইন্টার্ন জানাচ্ছেন, থ্রেট সিন্ডিকেটের এক ‘দাদা’কে শুধুমাত্র আন্তঃকলেজ ক্রিকেট টুর্নামেন্টে আউট করে দেওয়ায় ওই ‘দাদা’ হুমকি দিয়েছিলেন- ‘তোকে দেখে নেব।’ অভিযোগ, দেখেও নিয়েছিলেন ওই ‘দাদা’। আউটের শোধ তুলতে প্রথম দু’টি বর্ষের সবক’টি বিষয়ে ভালো নম্বর পাওয়া ওই এমবিবিএস ছাত্রকে তৃতীয় বর্ষের দু’টি বিষয়ে ফেল করিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
চতুর্থ বর্ষের এক পড়ুয়ার কথায়, ‘সিনিয়র পিজিটি-হাউসস্টাফ দাদাদের হুমকির প্রতিবাদে অভিযোগ জানিয়েছিলাম, কর্তৃপক্ষের কাছে। দেখলাম, সে কথা ওই দাদারা জেনে গিয়েছেন নিমেষে। উল্টে আরও হুমকি জোটে।’ এসএসকেএমে থ্রেট কালচারের অন্যতম অভিযুক্ত, সদ্যপ্রাক্তন হাউসস্টাফ রণজিৎ সাহা অবশ্য বলছেন, ‘এখান থেকেই আমার এমবিবিএস, ইন্টার্নশিপ এবং সব শেষে হাউসস্টাফশিপ। সেটাও মিটে গিয়েছে গত জুলাইয়ে। এর বাইরে একমাত্র কলেজের নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমার আগ্রহ আছে। আমার বিরুদ্ধে কেন এমন অভিযোগ তোলা হলো, তাতে আমিও বিস্মিত!’
একই ছবি কামারহাটির সাগর দত্ত কিংবা বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজেও। অভিযোগ, সাগর দত্তে আবার ২০১১-র জন্মলগ্ন থেকেই চলতো বিরূপাক্ষ বিশ্বাসের দাপাদাপি। যেমন বর্ধমানে চলতো অভীক দে-র তাণ্ডব। এই দু’জনের সঙ্গে বাকি অনেকের বিরুদ্ধেই সম্প্রতি শাস্তিমূলক পদক্ষেপ করা হয়েছে ঠিকই। অভীক-বিরূপাক্ষ সাসপেন্ডেড, রণজিৎ এসএসকেএম থেকে বহিষ্কৃত। কিন্তু ভবিষ্যতে ওঁরা ফিরে এলে থ্রেট কালচার ফিরে আসবে কি না, তা নিয়ে এখনই প্রমাদ গুনছেন ডাক্তারি পড়ুয়ারা। (শেষ)