• অসহায়তা মিথ্যা মামলার যুক্তি হতে পারে না, বক্তব্য হাইকোর্টের
    এই সময় | ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • বিস্ফোরক হলফনামা! এবং ততোধিক তাৎপর্যপূর্ণ হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ। নাবালিকার শ্লীলতাহানির মিথ্যা অভিযোগে তিন সাজাপ্রাপ্তকে জামিন এবং হাইকোর্টের স্বতঃপ্রণোদিত মামলা দায়েরের খবর প্রকাশিত হয়েছিল ‘এই সময়’-এর প্রথম পাতায় (বুধবার, ২৫.৯.২৪ তারিখ)। হাইকোর্টকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা দায়ের করতে দেখে বহু সিনিয়র আইনজীবী বলেছিলেন, এই সিদ্ধান্ত পরে নারীসুরক্ষায় তৈরি আইনের অপব্যবহারের মামলার ক্ষেত্রে একটি ল্যান্ডমার্ক হয়ে থাকতে পারে। সেই মামলাই আরও কয়েক গুণ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠল বুধবার।হাইকোর্টের ওয়েবসাইটে মঙ্গলবার গভীর রাতে আপলোড করা মামলার রায়ের কপিতে অভিযোগকারিণীর মায়ের দেওয়া হলফনামার উল্লেখ রয়েছে। সেখানে তিনি যে দাবি করেছেন, তা চমকে দেওয়ার মতোই। তাঁর দাবি, তাঁদের পরিবারের চূড়ান্ত আর্থিক অসহায়তার সুযোগ নিয়ে তাঁদের দিয়ে মিথ্যা অভিযোগ করানো হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে তিনি রাজ্যের শাসকদলের কয়েক জন স্থানীয় নেতার কথা উল্লেখ করেছেন। মিথ্যা মামলা দায়েরের জন্য নিঃশর্ত ক্ষমাও প্রার্থনা করেছেন হাইকোর্টের কাছে।

    কিন্তু জবাবে বিচারপতি অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিচারপতি অপূর্ব সিনহা রায়ের ডিভিশন বেঞ্চ যা বলেছে, তা আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন আইনজীবীদের একটি বড় অংশ। আদালতের স্পষ্ট বক্তব্য, নিরীহ ব্যক্তিদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর পিছনে দারিদ্র কোনও যুক্তিই হতে পারে না। রাজনৈতিক চাপ দিয়ে মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করানোর এই ঘটনাকে ‘ভয়ঙ্কর প্রবণতা’ হিসেবে মেনে নিলেও কোর্টের বক্তব্য, ‘এ ক্ষেত্রে ক্ষমার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। একজনের অসহায়তা বা দারিদ্র কি অন্যকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর অধিকার দেয়?’

    এখানেই শেষ নয়। আরও একটি নাটকীয় দিক উন্মোচিত হয়েছে অর্ডারের কপিতে। অভিযুক্তদের দাবি, পকসো আইনে অভিযোগ দায়ের করা হলেও অভিযোগকারিণী ঘটনার সময়ে মোটেই নাবালিকা ছিলেন না। অভিযুক্তদের দাখিল করা জামিনের আবেদনে দাবি, অভিযোগকারিণী সাবালিকা তো বটেই, বিবাহিতাও। একবার নয়, তাঁর বিয়ে হয়েছে দু’বার এবং দু’বারই তিনি বিবাহ-বিচ্ছেদ নিয়েছেন তাঁর স্বামীদের থেকে।

    অভিযুক্তদের তরফে হাইকোর্টে বিবাহ-বিচ্ছেদের প্রমাণ হিসেবে যে নথি পেশ করা হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে অভিযোগকারিণীর দু’টি বিবাহ-বিচ্ছেদের তারিখ ৬.৯.২০২২ এবং ৩.৩.২০২৩। এই দু’টি নথিতেই অভিযোগকারিণীকে সাবালিকা হিসেবে দেখানো হয়েছে। অথচ বহরমপুর থানায় পকসো আইনের আওতায় তিন জনের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগটি দায়ের হয়েছিল ৯.৮.২০২৩ তারিখে। যা কোর্টের কাছেও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে।

    এই সব যুক্তিতে অভিযোগকারিণীর মায়ের ক্ষমার আবেদন সটান খারিজ করে হাইকোর্টের নির্দেশ, মুর্শিদাবাদের এই পকসো মামলায় নিম্ন আদলতের বিচারক বিস্তারিত শুনানি করবেন। এই শুনানির আওতায় অভিযোগকারিণী ও তাঁর পরিবার থেকে শুরু করে যাঁদের বিরুদ্ধে অসহায়তার সুযোগ নিয়ে মিথ্যা মামলা দায়েরে প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে— তাঁদের সকলেই আসবেন। বিচার ও পরবর্তী তদন্তের আওতায় আসবে তরুণীর বিরুদ্ধে বয়স ভাঁড়ানোর অভিযোগও।

    শুনানি চলাকালীন অভিযোগকারিণীর মায়ের আইনজীবী সৌম্যজিৎ দাস মহাপাত্র হাইকোর্টে জানান, হলফনামা দিয়ে তাঁর মক্কেল আদালতকে সব সত্যি কথা জানাতে চান। সেই হলফনামায় অভিযোগকারিণীর মায়ের দাবি, তাঁর স্বামী পেশায় রাজমিস্ত্রি ছিলেন। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে বহুতল থেকে পড়ে যান। ২০১৬ সাল থেকে তিনি পঙ্গু এবং শয্যাশায়ী। আয়ের কোনও পথ নেই পরিবারটির। সরকারি অনুদানের সামান্য টাকায় কোনওক্রমে সংসার চলে।

    গত বছর জুলাইয়ে শাসকদলের স্থানীয় কয়েক জন নেতা এসে ওই পরিবারের কাছে তিন জনের নামে মিথ্যা অভিযোগ আনার প্রস্তাব দেয়। যদিও নিরাপত্তার কারণে এই নেতাদের নাম হলফনামায় তিনি উল্লেখ করেননি। অভিযোগ, আরও সরকারি প্রকল্পে আর্থিক সহায়তার টোপ তাঁদের দেওয়া হয়। সমান্তরাল ভাবে চলতে থাকে হুমকিও— বর্তমানে যেটুকু টাকা সরকারি প্রকল্পে আসছে, মিথ্যা অভিযোগ দায়ের না করলে তা-ও বন্ধ হয়ে যাবে।

    অভিযোগকারিণীর পরিবারের বক্তব্য, যে নির্দিষ্ট তিন জনের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনার কথা বলা হয়েছিল, তাঁরা সকলেই শাসকদল ছেড়ে অন্য দলে যোগ দিয়েছিলেন। ফলে স্থানীয় ভাবে শাসকদলের সংগঠন দুর্বল হয়ে পড়েছিল। যদিও মিথ্যা অভিযোগ দায়েরের পরেও প্রতিশ্রুতিমতো তাঁদের কোনও সুবিধা দেওয়া হয়নি বলে দাবি তরুণীর মায়ের।
  • Link to this news (এই সময়)