এই সময়: আরজি করের ধর্ষণ-খুনের ঘটনায় তথ্যপ্রমাণ লোপাটে বৃহত্তর ষড়যন্ত্র হয়েছিল এবং টালা থানার প্রাক্তন ওসি অভিজিৎ মণ্ডল ও আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের তাতে প্রত্যক্ষ যোগ ছিল বলে আগেই দাবি করেছিল সিবিআই। সেই তথ্যপ্রমাণ বদল ও ভুয়ো তথ্যপ্রমাণ তৈরির কাজ টালা থানাতেই হয়েছিল বলে বুধবার বিস্ফোরক দাবি করল কেন্দ্রীয় এজেন্সি।এ দিন শিয়ালদহ আদালতে পেশ করা হয় অভিজিৎ ও সন্দীপকে। সেখানে সিবিআই কৌঁসুলি দাবি করেন, ‘ফলস রেকর্ড ক্রিয়েটেড অ্যান্ড রেকর্ড অলটার্ড। টালা থানার অন্দরেই তথ্যপ্রমাণ বদল এবং ভুয়ো রেকর্ড তৈরির কাজটা হয়েছে।’ সিবিআইয়ের দাবি, এই মামলায় বিভিন্ন অভিযুক্তকে জেরা করে এবং পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতেই এই বিষয়টা জানা গিয়েছে।
তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ-খুনের পরে অকুস্থলে তথ্যপ্রমাণ নষ্টের অভিযোগ প্রথম থেকেই করে আসছিলেন আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তাররা। এমনকী নির্যাতিতার পরিবারও একই সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু থানার মধ্যেই তথ্যপ্রমাণ নষ্ট করা হয়ে থাকলে তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মত আইনজ্ঞদের একাংশের। তাঁদের যুক্তি, এর অর্থ সুপরিকল্পিত ভাবে এই কাজটা করা হয়েছে এবং সেটা হয়ে থাকলে কেন কলকাতা পুলিশের সিটের নজরে এটা এলো না— আগামী দিনে সে প্রশ্নও উঠবে। বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের বিষয়টা আরও বিস্তারিত ভাবে খতিয়ে দেখতে অভিজিতের পলিগ্রাফ ও সন্দীপের নার্কো টেস্ট করাতে চেয়ে আদালতে আর্জি জানিয়েছে সিবিআই।
যদিও সেন্ট্রাল ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরির (সিএফএসএল) কলকাতা অফিসের বিশেষজ্ঞ একটি মামলার কাজে বাইরে থাকায় এ দিনও শুনানি হয়নি। ৩০ সেপ্টেম্বর ফের সেই আবেদনের শুনানি হওয়ার কথা। ওই দিন পর্যন্ত অভিজিৎ ও সন্দীপকে জেল হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন শিয়ালদহের অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট অরিজিৎ মণ্ডল। ফলে তিন দফায় মোট ১১ দিন সিবিআই হেফাজতে থাকার পরে এ বার পাঁচদিনের জেল হেফাজতে যেতে হচ্ছে দুই অভিযুক্তকেই। ঘটনাচক্রে ৩০ সেপ্টেম্বরই সুপ্রিম কোর্টে আরজি কর মামলার শুনানি নির্ধারিত রয়েছে।
বুধবার এই মামলার শুনানির আগে সকাল থেকেই শিয়ালদহ কোর্টের সামনের দরজা ব্যারিকেড দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়। দুই অভিযুক্তকে আদালতে নিয়ে আসার পর প্রথমে তাঁদের কোর্ট লক-আপে রাখা হয়। ততক্ষণে এজলাসে ভিড় করতে শুরু করেন আইনজীবীরা। আগের দু’দিনের মতো মতো এ দিনও অভিজিৎ ও সন্দীপের হয়ে আইনজীবীরা যাতে সওয়াল না-করেন, সেই দাবি তুলে শিয়ালদহ কোর্টের আইনজীবীদের একাংশ এজলাসেই প্রতিবাদে মুখর হন।
কোর্টেই শোনা যায় ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগান। শেষ পর্যন্ত অবশ্য বিচারকের হস্তক্ষেপে শান্তি ফিরলে শুনানি শুরু হয়। তবে অভিযুক্তদের এজলাসে আনা হয়নি। তাঁরা কোর্ট লক-আপেই ছিলেন। সুপ্রিম কোর্টে আরজি কর মামলা চলাকালীন যাতে লাইভ স্ট্রিমিং না-হয়, সে জন্য রাজ্যের তরফে প্রবীণ কৌঁসুলি কপিল সিবাল আবেদন করেছিলেন। সেই আর্জিতে সায় দেয়নি শীর্ষ আদালত।
এ দিন শিয়ালদহ কোর্টে সিবিআইয়ের তরফেও আর্জি জানানো হয়, এই মামলার ‘ইন-ক্যামেরা’ বা রুদ্ধদ্বার শুনানির জন্য, যাতে সংবাদমাধ্যমের কাছে এই মামলা সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য চলে না যায়। তবে শেষ পর্যন্ত সেই আবেদন খারিজ হয়ে যায়। টালার প্রাক্তন ওসির আইনজীবী অয়ন ভট্টাচার্য আদালতে যুক্তি দেন, তাঁর মক্কেলের বিরুদ্ধে যে সব ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে, সেগুলি সবই জামিনযোগ্য। তাঁর দাবি, টালার প্রাক্তন ওসি গত ৯ অগস্ট তাঁর কাজ সঠিক ভাবেই করেছিলেন। ঘটনার দিন সকাল সাড়ে ন’টা নাগাদ খবর পাওয়ার পরে ওসি সকাল সাড়ে ১০টায় ঘটনাস্থলে পৌঁছন।
সিবিআই কৌঁসুলির বক্তব্য, টালা থানার সিসিটিভি ফুটেজ-সহ ডিজিটাল ভিডিয়ো রেকর্ডার (ডিভিআর) এবং হার্ড ডিস্ক ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। সেই তথ্যও দ্রুত চলে আসবে বলে জানিয়েছে সিবিআই। তদন্তকারীদের দাবি, থানার মধ্যেই যে তথ্যপ্রমাণ বদলের কাজ হয়েছে, সেটা সিসিটিভি ফুটেজের ফরেন্সিক রিপোর্ট হাতে এলেই আরও স্পষ্ট হবে। যদিও অভিজিৎ এ দিন বলেন, ‘আমাকে বেআইনি ভাবে গ্রেপ্তার করেছে সিবিআই। গ্রেপ্তারির কারণ জানানো হয়নি। আর ঘটনাস্থল তো থানা নয়। তথ্য নষ্ট করা আমার হাতে নেই।’ কতদিন তাঁকে জেলে থাকতে হবে, সে প্রশ্নও তোলেন তাঁর আইনজীবী।
সিবিআই কৌঁসুলি বলেন, ‘আমাদের হাতে তো কোনও জাদুদণ্ড নেই। তাই তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করতে সময় লাগছে।’ সুপ্রিম কোর্টও এর আগে বলেছিল, সিবিআই তদন্ত সঠিক পথেই এগোচ্ছে, তবে তাদের আরও সময় দিতে হবে।