• মোবাইল ফেলে আরজি করের ঘটনায় পথে নামছেন নতুন প্রজন্মের সোহমরা
    এই সময় | ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • নতুন প্রজন্মের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রসঙ্গে বার বার উঠে আসে মোবাইল-নির্ভরতার কথা। বেহালার সোহম ভট্টাচার্য পার্ক স্ট্রিটের এক নামী কলেজে পড়েন। কলেজের বাইরে সঙ্গী বলতে শুধুই মোবাইল। সেখানে নানা রকম গেম, দাবা খেলে সময় কাটান।ঘরে ঘরে ছড়িয়ে রয়েছেন সোহমরা। বহু বাবা-মায়ের মাথাব্যথার অন্যতম কারণ সন্তানদের মুঠোফোন। এই প্রজন্মের ৬-৭ জন এক জায়গায় জড়ো হলেও দেখা যায়, যে যাঁর নিজের মোবাইলে মগ্ন। অনেক সময়ে তাঁরা পাশাপাশি বসে মোবাইলেই গ্রুপ-গেম খেলেন।

    মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জয়রঞ্জন রামের কথায়, ‘মোবাইলের মধ্যে একটা সর্বগ্রাসী ব্যপার আছে। এই প্রজন্মের যা প্রয়োজন, তা মোবাইলের মাধ্যমেই মিটিয়ে নিচ্ছেন তাঁরা। ফলে অন্য কারও সঙ্গে কথা বলা, গল্প করা এখনকার প্রজন্মের মধ্যে নেই।’ বাবা-মায়েদের ধারণা, এই মোবাইল নির্ভরতা আরও যেন বাড়িয়ে দিয়েছে ফেলে আসা কোভিড-কাল।

    অথচ অনেকের মতে, আরজি করের ঘটনার পর থেকে কিছুটা হলেও যেন ভাঙতে শুরু করেছে সেই ধারণা। জয়রঞ্জনও স্বীকার করে নিচ্ছেন, ‘আরজি করের এই ঘটনাটা কোথাও যেন নিজেদের সঙ্গে রিলেট করতে পেরেছেন নতুন প্রজন্ম। মোবাইলের নেশা ছেড়ে রাস্তায় নামছেন তাঁরাও।’ সোহমের বাবা সুজিত ভট্টাচার্যও জানিয়েছেন, আরজি করের প্রতিবাদ মিছিল, অবস্থান-বিক্ষোভ যেন বদলে দিয়েছে সোহমকে। কিছু দিন আগে পাড়ায় একটা সমস্যা হয়েছিল। সোহম এসে একবারও জিজ্ঞেস করেননি কী হয়েছে। অথচ আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদে সোহমকে হাঁটতে দেখা গিয়েছে একাধিক বার।

    কলেজ, এমনকী স্কুল পড়ুয়াদের অনেকেই নেমে এসেছেন পথে। ১৪ অগস্ট, প্রথম রাত দখলের মিছিলে বড় সংখ্যায় দেখা গিয়েছে তাঁদের। তারপর থেকে একের পর এক রাত-দখল, প্রতিবাদ মিছিলে হাঁটতে দেখা গিয়েছে ‘ঘরকুনো’ বলে দেগে দেওয়া এই প্রজন্মকে। স্বাস্থ্য ভবনের সামনে জুনিয়র ডাক্তারদের পাশেও থেকেছেন তাঁরা। আরজি করে নিহত তরুণীর এমবিবিএস ব্যাচমেট চিকিৎসক ঋষভ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘এমন ভয়াবহ নির্যাতন হয়তো মেনে নিতে পারেনি মোবাইলকে সঙ্গী করে ঘরে থাকা ছেলেমেয়েরাও। তাঁদের অনেকেই চাকরি করেন। কারও বোন, কারও দিদি অফিসে যান।’

    সমাজতত্ত্ববিদ অনিরুদ্ধ চৌধুরীর কথায়, ‘যখন কোনও ক্রাইসিস আসে, তখন মানুষ বেঁধে বেঁধেই থাকে। মিশতে পারা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিছিলে পা মেলাচ্ছেন ঘরকুনো, মোবাইল-মুখী ছেলেমেয়েদের দল। এই আন্দোলনের এটাও একটা পাওনা। অনেক সুপ্ত আশা খোলা জায়গায় নিয়ে এলেন এঁরা।’

    সদ্য বি-কম পাশ করেছেন মধ্যমগ্রামের তন্ময় বসু। পাড়ায় বেরোন না। তন্ময়ের মা-ই বলছেন, ছেলে নিজের মতো সময় কাটাতেই পছন্দ করেন। ১৪ অগস্টের রাত-দখলের রাতে তাঁকেই দেখা গেল মধ্যমগ্রাম চৌমাথায়। তন্ময় বলছেন, ‘যা ঘটেছে, তা মেনে নেওয়া যায় না। ভাবলাম এ বার প্রতিবাদ হোক।’ উত্তর কলকাতার স্কুলছাত্রী, বেলেঘাটার দশম শ্রেণির শ্রেয়সী চৌধুরী শান্ত স্বভাবের। পাড়ায় তেমন মেশে না বলে দাবি প্রতিবেশীদের। কিন্তু এক রবিবারের দুপুরে আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদ মিছিলে তাকেই হাঁটতে দেখে অবাক হয়েছিলেন পাড়ার লোকজনও।

    এই প্রজন্মের মনে কোথাও হয়তো একটা আন্দোলন লুকিয়ে ছিল বলে মনে করেন অনিরুদ্ধ। বলেন, ‘এই আন্দোলন তো শুধু বিচারের জন্য নয়। নিরাপত্তার দাবিতেও। ভালো চাকরি না-পাওয়া, ভালো রেজাল্ট করে বাড়িতে বসে থাকা, সঙ্গে দুর্নীতি ও অবক্ষয়ের ছবি ভীষণ ভাবে নাড়া দিয়েছে নতুন প্রজন্মকেও। তাঁরা একে সম্ভবত সরকার-বিরোধী আন্দোলন হিসেবে দেখছেন।’

    জয়রঞ্জনের মতে, মানুষ অনেক দিন ধরে রাজনীতিবিদদের ঔদ্ধত্য সহ্য করছিল। সেই রাগ প্রকাশ্যে এসেছে। তিনি বলেন, ‘কর্মরত থাকা অবস্থায় এক তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুন কেউই মেনে নিতে পারেননি। তাই পথে নেমেছে প্রত্যেক প্রজন্ম। মানুষের মধ্যে একতা তৈরি করেছে।’ শান্ত স্বভাবের দশম শ্রেণির ছাত্রী শ্রেয়সীর কথায়, ‘এই প্রতিবাদ চলুক যতদিন না দোষীদের সাজা হয়। আমরা যেন এই আন্দোলনের মোড় অন্য দিকে ঘুরে যেতে না দিই।’
  • Link to this news (এই সময়)