দিলীপ এবং ডিন্ডাকে সতর্ক করে দিলেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, জুনিয়র ডাক্তারদের নিয়ে মন্তব্যে সতর্ক হচ্ছে বিজেপি
আনন্দবাজার | ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪
আরজি কর-কাণ্ড নিয়ে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনকে কোনও সমালোচনা নয়। কারণ, চিকিৎসকদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সমর্থন রয়েছে। প্রথম থেকেই বিজেপির এই নীতি ছিল। আন্দোলনের কিছু কিছু বিষয় পদ্মশিবিরের অপছন্দের থাকলেও দলের কোনও প্রথম সারির নেতা তা নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করেননি। কিন্তু সম্প্রতি প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ এবং ময়নার বিধায়ক অশোক ডিন্ডা দলের সেই ‘নীতি’ ভেঙেছেন। দু’জনেই সমালোচনা করেছেন জুনিয়র ডাক্তারদের। সেটা যে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ভাল চোখে দেখছেন না, তা বৃহস্পতিবার দলের বৈঠকে স্পষ্ট করে দিলেন রাজ্য বিজেপির সহ-পর্যবেক্ষক অমিত মালব্য।
বৃহস্পতিবার দুপুরে বিজেপির রাজ্য কমিটির বৈঠকে অমিত ছাড়াও ছিলেন পর্যবেক্ষক মঙ্গল পাণ্ডে। সেখানে রাজ্যের সব পদাধিকারী থাকলেও ছিলেন না দিলীপ বা ডিন্ডা। বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে, সেই বৈঠকেই অমিত জানিয়েছেন, জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন নিয়ে ‘এক্তিয়ার’ ভেঙে কেউ কোনও মন্তব্য করতে পারবেন না। দলের নীতির বাইরে গিয়ে কোনও মন্তব্য করা যাবে না জানানোর পাশাপাশি অমিত বৈঠকে এ-ও বলেন যে, দলের পক্ষে যাঁদের দায়িত্ব দেওয়া রয়েছে, সেই সব মুখপাত্রেরাই শুধু ওই বিষয়ে মুখ খুলবেন।
জুনিয়র ডাক্তারেরা তাঁদের আন্দোলনে কোনও রাজনৈতিক ছায়া থাকতে দেবেন না বলে প্রথম থেকেই কঠোর ছিলেন। তাঁদের লালবাজার অভিযানের সময় বিজেপি সাংসদ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় গেলে ফিরিয়ে দেন চিকিৎসকরা। স্বাস্থ্য ভবনের সামনের রাস্তায় ধর্না চলার সময়ে বিধায়ক তথা রাজ্যের সাধারণ সম্পাদক অগ্নিমিত্র পালকে ‘গো ব্যাক’ ধ্বনি শুনতে হয়। তবে অগ্নিমিত্রার বক্তব্য ছিল, তিনি দলের দফতরে যাচ্ছিলেন। এটা ঠিক যে জুনিয়র ডাক্তারদের ধর্না ছিল সল্টলেক সেক্টর ফাইভের বিজেপি দফতরের একেবারে কাছে। সেই ঘটনার পর থেকে বিজেপির প্রথম সারির নেতারা আর ওই অফিস মুখো হননি। অনেক দিন পর বৃহস্পতিবার সব রাজ্য নেতা বৈঠকে বসেছিলেন ওই দফতরে। সেখানেই দিলীপ এবং ডিন্ডার বক্তব্য নিয়ে আলোচনা হয়।
গত সোমবার ডিন্ডা চিকিৎসকদের আন্দোলনকে ‘স্বার্থপর’ আখ্যা দেন। ময়নার বিজেপি বিধায়ক বলেছিলেন, ‘‘এই ডাক্তাররা আন্দোলন করল। পাশে দাঁড়ালাম। অদ্ভুত ভাবে যে পাঁচটা দাবি করল, সেখানে ফাঁসির দাবিই নেই। যে দাবি নিয়ে আন্দোলন করল, সেগুলো সাধারণ দাবি। ৩৬৫ দিনই করা যায়। ফাঁসির দাবি তো নেই। মুখ্যমন্ত্রী কন্ট্রোল করে ফেললেন। ডাক্তারদের ওপর মানুষর শ্রদ্ধা নেই।’’ ঠিক তার পর দিনই বর্ধমানে দিলীপ বলেন, “এত নাটক করে কী লাভ হল? যাঁরা বদলি হলেন, তাঁরা প্রোমোশন পেলেন। মোমবাতি জ্বেলে, তালি দিয়ে কী লাভ হল? কেন মানুষ দেড় মাস কষ্ট করলেন? হাসপাতালের যে অব্যবস্থা, তার কি কোনও পরিবর্তন হল? এই প্রশ্ন মানুষের মুখে ঘুরছে।” তিনি এমনও বলেন যে, ‘‘এই যে আন্দোলন করা হল মানুষকে খেপিয়ে, তাতে কী লাভ হল? আপনারা সরকারের বিরুদ্ধে একটা কথা বলছেন না! সন্দীপ ঘোষ ছাড়া পেয়ে যাবে অনুব্রত মণ্ডলের মতো! তার পরে বিনীত গোয়েল দিব্যি ঘুরে বেড়াবেন! স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ হবে না? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুলিশমন্ত্রী। তাঁর কোনও সাজা হবে না?’’ দিলীপ প্রশ্ন তোলেন, ‘‘পিছন থেকে এই আন্দোলন যাঁরা চালাচ্ছেন, তাঁরা মমতাকে বাঁচানোর জন্য এ সব নাটক করছেন না তো?’’
দিলীপের পাশে যে দল নেই, তা বুঝিয়ে সেই দিনই অগ্নিমিত্রা বলেছিলেন, ‘‘দিলীপদা কেন, কী বলেছেন এবং তার অন্য কোনও ব্যাখ্যা হচ্ছে কি না, সে সব না-জেনে বলতে পারব না। তবে ব্যক্তিগত ভাবে এবং দল হিসাবে আমরা ডাক্তারদের আন্দোলনের পক্ষে ছিলাম, আছি। ভবিষ্যতেও থাকব।’’ এ বার কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তরফেও একই বার্তা পেলেন দিলীপ ও ডিন্ডা।
তবে তার আগেই জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে বিজেপির ‘দূরত্ব’ আরও বেড়ে গিয়েছে। দিলীপের মন্তব্যের পরে আন্দোলনকারীদের পক্ষে ডাক্তার কিঞ্জল নন্দ বলেছিলেন, “যেটুকু হয়েছে, তা এই আন্দোলনের জন্যই হয়েছে। মানুষের আন্দোলনকে নাটক বলা হলে সাধারণ মানুষকেই অপমান করা হয়। তাঁদের (রাজনীতিকদের) হাতেও তো অনেক ক্ষমতা রয়েছে। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে তাঁরা কী করেছেন?” বুধবার জুনিয়র ডাক্তারদের সাংবাদিক বৈঠকে দেবাশিস হালদার বলেন, ‘‘রাজ্যের ক্ষমতা দখলের ক্ষুদ্র স্বার্থে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল গোড়া থেকেই আমাদের আন্দোলনকে ব্যবহার করতে চাইছে। আমরা বার বার স্পষ্ট করে জানিয়েছি, হাথরস-কাঠুয়া-উন্নাওতে যাঁরা ধর্ষকদের মালা পরিয়েছেন, তাঁদের ক্ষমতা দখলের চক্করে আমাদের আন্দোলনকে ব্যবহার করতে দেব না। জনগণ দেবে না।’’
বিজেপির অনেকেই মনে করছেন, দিলীপ বা ডিন্ডা আগ বাড়িয়ে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের সমালোচনা না করলে এত কথা শুনতে হত না। এর ফলে জনগণের থেকেও দলের দূরত্ব বাড়ছে। সেই ভাবনা যে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মধ্যেও রয়েছে, তা স্পষ্ট হল বৃহস্পতিবার। বৈঠকে পর্যবেক্ষক মঙ্গল উপস্থিত থাকলেও তিনি এ নিয়ে কিছু বলেননি। তিনি জোর দিয়েছেন পুজোর পরেই রাজ্যে সদস্য সংগ্রহ অভিযানে গতি আনার পরিকল্পনার উপর। প্রসঙ্গত, সব রাজ্যেই সেই কর্মসূচি গত ২ সেপ্টেম্বর শুরু হয়েছে। আরজি কর-কাণ্ড নিয়ে আন্দোলনের জন্য অক্টোবর পর্যন্ত ছাড় পেয়েছে রাজ্য বিজেপি।