ধর্ষণের পরে হাতুড়ি মেরে খুন, দেড় বছর পরে মৃত্যুদণ্ড সেই পড়শির
এই সময় | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪
এই সময়: শুধুই বিরলের মধ্যে বিরলতম অপরাধ নয়, এই ধরনের অপরাধীকে দয়া দেখানোর অর্থ নিরীহ ও নিরপরাধকে আরও বিপদে ফেলা— এই যুক্তিতে তিলজলায় নাবালিকাকে ধর্ষণ-খুনের মামলায় মৃত্যুদণ্ডের সাজা ঘোষণা করল আদালত। ২০২৩-এর ২৬ মার্চ সাত বছরের এক বালিকাকে ধর্ষণের পরে মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে খুনের অভিযোগ ওঠে অলোক শাহ নামে ওই বাড়িরই এক ভাড়াটের বিরুদ্ধে।অপরহণ, ধর্ষণ, অপ্রাকৃতিক যৌন নির্যাতন, খুন, তথ্যপ্রমাণ লোপাটের মতো ভারতীয় দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারার পাশাপাশি শিশুদের উপর যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ আইনে (পকসো) মামলা রুজু হয়। ওই নৃশংস ঘটনার প্রায় ১৮ মাস পরে বিচারপ্রক্রিয়া শেষ করে অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছেন আলিপুরের পকসো আদালতের বিচারক সুদীপ্ত ভট্টাচার্য।
বৃহস্পতিবার রায় দিতে গিয়ে আদালতের পর্যবেক্ষণ, ‘সাত বছরের যে শিশুর খেলা করার বয়স, শক্ত-সমর্থ চেহারার পূর্ণবয়স্ক একজন অভিযুক্তের হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর সামর্থ্য তার ছিল না। তবুও সে আসামির হাতে কামড়ে দিয়ে উদ্ধার পাওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পেরে ওঠেনি।’ সরকারি আইনজীবী শিবনাথ অধিকারী ও মাধবী ঘোষ মাইতির কথায়, ‘বড়দের সঙ্গে নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে অনেক সময়ে তাঁর পোশাক বা চরিত্রের দিকে আঙুল তোলা হয়। কিন্তু সাত বছরের একটা ফুটফুটে মেয়েকে এমন নৃশংস ভাবে হত্যা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিই রাখে।’
ঘটনার দিন সকালে মায়ের কথায় তিলজলার একটি বহুতলের তিনতলার ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে মেয়েটি প্রথমে নীচে আবর্জনা ফেলতে নেমেছিল। জঞ্জাল ফেলার পর বাড়ির কাছেই একটি দোকান থেকে দুধের প্যাকেট নিয়ে বাড়ি ফেরার কথা ছিল তার। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ পেরিয়ে গেলেও বাড়ি ফেরেনি সে।
পরে জানা যায়, ওই বালিকা দুধের দোকান পর্যন্ত আদৌ যায়নি। পুলিশের কাছে নাবালিকার পরিবার অভিযোগ জানাতে গেলে প্রাথমিক ভাবে থানার বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ ওঠে। তিলজলা ও পার্ক সার্কাস অঞ্চলে বিক্ষুব্ধরা গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেন। ভাঙচুর করা হয় তিলজলা থানাও। চলে ট্রেন অবরোধ।
যদিও তারপরে পুলিশ তদন্ত শুরু করে এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ দেখে। তল্লাশি চালানো হয় ওই বহুতলের প্রতিটি ফ্ল্যাটে। সেই সময়ে বহুতলের চারতলায় অলোক শাহের ফ্ল্যাটের রান্নাঘরের গ্যাস সিলিন্ডারের পাশে একটি বস্তায় হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মেয়েটির ক্ষতবিক্ষত দেহ উদ্ধার হয়। তদন্তে উঠে আসে, অভিযুক্ত যুবক মেয়েটির উপর নজর রাখছিল বেশ কিছুদিন ধরেই। নাবালিকার বেশ কিছু ছবিও তুলে রেখেছিল। ঘটনার দিন ছিল রবিবার।
ওই দিনই মেয়েটিকে অপহরণের ছক কষা হয়েছিল প্ল্যানমাফিক। পুলিশের দাবি, ওই বহুতলের গ্রাউন্ড ফ্লোরে একটি কারখানা ছিল। সেই কারখানাটি রবিবার বন্ধ থাকত। অন্য দিন সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ সেখানে কর্মীরা ঢুকতে শুরু করতেন। ফলে সেই সময়ে মেয়েটিকে অপহরণ করতে গেলে সহজেই অলোকের ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকত। নজর এড়াতে তাই রবিবার সকালে নাবালিকা নীচে নামার পরেই তাকে চকোলেটের লোভ দেখিয়ে অলোক নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে যায়। ধর্ষণের পরে খুন করে দেহ লুকিয়ে রাখে ফ্ল্যাটেই।
ময়নাতদন্তের রিপোর্টের উল্লেখ করে সরকারি কৌঁসুলিরা আদালতে জানান, ওই বালিকার হাত ও মুখ বেঁধে প্রথমে ধর্ষণ করা হয় এবং তারপর তার মাথায় হাতুড়ি দিকে আঘাত করে হত্যা করা হয়। তার শরীরে মোট ২৬টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছিল। ২০২৩-এর ১৬ জুলাই এই মামলার চার্জশিট জমা দেয় পুলিশ। স্পেশ্যাল পকসো কোর্টে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন ৪৫ জন।
পুলিশের জেরায় অভিযুক্ত অলোক দাবি করেছিল, ঘটনার সময়ে তার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা ছিলেন। ভাবী সন্তান ছেলে না মেয়ে সেই বিষয়ে জানতে সে নিমতলা ঘাটের কাছে এক তান্ত্রিকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। তার দাবি, ওই তান্ত্রিক জানিয়েছিল যদি সে একটি শিশুকন্যাকে বলি দেয়, তাহলে সে পুত্র সন্তানের পিতা হবে। সেই কারণেই সে পড়শি সাত বছরের মেয়েটিকে বেছে নিয়েছিল। এমনকী তার ছবি তুলে তান্ত্রিককে দেখিয়েও নিয়েছিল।
যদিও এমন কোনও তান্ত্রিকের সঙ্গে অলোকের যোগাযোগের বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন তার স্ত্রী। পুলিশও নিমতলা ঘাটে গিয়ে বর্ণনা অনুযায়ী কোনও তান্ত্রিকের খোঁজ পায়নি। পুলিশের জেরায় অলোক তান্ত্রিকের তত্ত্ব তুলে ধরলেও আদালত সূত্রের খবর, এই মামলার বিচারপ্রক্রিয়া চলাকালীন সে বারবারই নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করেছিল। সাজা ঘোষণার সময়েও একই কথা শোনা যায় তার গলায়।