গুপ্তমন্ত্রে শিখরবাসিনী দুর্গার পুজো শুরু পঞ্চকোট রাজপরিবারে, ১৬ দিন চলবে মায়ের আরাধনা
প্রতিদিন | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪
সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: পঞ্চকোটের ঠাকুরদালান থেকে ভেসে আসছে, ‘জয় দুর্গে দুরধী গম্য রূপিনী/ দুরন্ত দুর্গা শুর নিশুদিনী/ দীন দুর্বল তারিনী জননী দুরিত হারিনী।’ দেবীপক্ষের আগেই পুজো শুরু শিখরবাসিনী দুর্গাপুজো। রাবণবধের জন্য রামচন্দ্র দুর্গার ‘বোধন’ করেছিলেন। সেই অকালবোধনের মত অনুসারে দেবীপক্ষের আগেই শুরু হল পুরুলিয়ায় পঞ্চকোট রাজপরিবারের পুজো(Bonedi Barir Durga Puja)।
জিতাঅষ্টমীর পরের দিন বুধবার সন্ধ্যায় আদরা নক্ষত্রযুক্ত কৃষ্ণপক্ষের নবমীতে এই পুজো হয়। ১৬ দিন ধরে এই পুজো চলবে। বনমহলের এই দুই রাজ পরিবারে। এই পুজোকে ১৬ কল্পের দুর্গাপুজোও বলা হয়।
এই রাজপরিবারের রাজরাজেশ্বরী আলয়ে উমা আসেন আগমনী গানে। শিখরবাসিনী দুর্গার পুজো হয় গুপ্তমন্ত্রে। এখানে মায়ের আসনও গুপ্ত। পুজোর মন্ত্র এতটাই গোপনীয় যে মন্ত্রের লিপি আজও অপ্রকাশিত। দুহাজারেরও বেশি বছর পরেও কোনও কাগজ, খাতায় লিপিবদ্ধ হয়নি। শুধু গাছের ছালে সংস্কৃত ও পালি ভাষায় ৯ টি পাতায় নয়টি লাইন লেখা। সেই গুপ্তাতিগুপ্ত ‘শ্রীনাদ’ মন্ত্র উচ্চারণ, আগমনী গান, বলি ও আরতির মাধ্যমে পঞ্চকোট রাজপরিবারে পুজো শুরু হয়ে গিয়েছে পিতৃপক্ষে, মহালয়ার আগেই।
মা শিখরবাসিনী দুর্গা এখানে অষ্টধাতুর তৈরি। চতুর্ভুজা। একহাতে জপমালা, অন্যহাতে বেদ। আর দুই হাতে বরদা ও অভয়া। গলায় নর মুণ্ডমালা। পদ্ম ফুলের ওপর বসে থাকা রাজরাজেশ্বরী পুজো চলবে মহানবমী পর্যন্ত।
কথা হচ্ছিল পঞ্চকোট রাজপরিবারের সদস্য তথা সিপাহী বিদ্রোহের মূল উদ্যোক্তা মহারাজাধিরাজ নীলমনি সিং দেওর প্রপৌত্র সৌমেশ্বরলাল সিং দেওর সঙ্গে। তাঁর কথায়, “নিত্যপুজোতে মা অধিষ্ঠান করেন তাঁর ঐতিহ্যশালী বেদিতে। মার্বেল পাথরের একটি বড় সিংহাসনের ওপরে একটি রুপোর সিংহাসনের মাঝে সোনার সিংহাসনের মাথায়। মহাসপ্তমীর দিন অর্ধরাত্রি বিহীত পুজোর পর্বে দশমীর পূর্বাহ্ন পর্যন্ত মাকে গুপ্ত আসনে বসানো হয়। অষ্টাদশভূজা মহিষাসুরমর্দিনী রূপে আমরা মায়ের চরণে অঞ্জলি দিই।” মায়ের গুপ্ত আসনকে বলা হয় ‘সোড়ন’। এই সময় একটি তলোয়ারও পুজো পায়। যার নাম ‘ভূতনাথ তাগা’।
জঙ্গলমহলের এই পুজোর পরতে পরতে জড়িয়ে আছে ইতিহাস। কথিত মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়নীর ধার নগরের মহারাজা বিক্রমাদিত্যের বংশধর জগদ্দেও সিং দেওর কনিষ্ঠ পুত্র দামোদর শেখর সিংদেও বাহাদুর চাকলা পঞ্চকোটরাজের প্রতিষ্ঠাতা। এই রাজস্থাপনের সময় থেকেই তাঁর পূর্বপুরুষ কুলপ্রথা অনুযায়ী শকাব্দ ২ থেকে এই পুজো শুরু করেন দামোদর শেখর। তাঁর নামানুসারে এই বিস্তীর্ণ জঙ্গলমহলের নাম ‘শেখরভূম’ বা ‘শিখরভূম’ নামকরণ হয়। তাই এই দুর্গার নামও হয় শিখরবাসিনী দুর্গা।
বর্তমানে পঞ্চকোট রাজ দেবোত্তর-র সেবাইত বিশ্বজিৎপ্রসাদ সিং দেও-র তত্ত্বাবধানে পুজো হয়। এই রাজবংশের রাজধানী গড়পঞ্চকোট থেকে শুরু করে পাড়া, কেশরগড়, কাশিপুর যেখানে রাজত্ব স্থানান্তরিত হয়েছে সেখানেই এই পুজো চলছে ধুমধাম সহকারে। যে বনমালী পন্ডিতের হাত ধরে এই পুজো হয় তাঁর বংশধর গৌতম চক্রবর্তী এখন এই পুজো করেন। তাঁর কথায়, “৮০ তম পুরুষ ধরে এই গুপ্ত মন্ত্রে মায়ের পুজো চলছে। যে গাছের ছালে এই মন্ত্র লেখা রয়েছে তার অবস্থা করুন। হাত দিলেই ঝুরঝুর করে পড়তে থাকে। ওই ভূর্জ পত্র মায়ের চরণে রেখে দিই। গুপ্ত মন্ত্র আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। দেখতে হয় না।”
রাজপরিবারের সদস্যরা বলেন, “রাজরাজেশ্বরী দেবী-ই হলেন কল্যানেশ্বরী দেবীর প্রতিমূর্তি। যিনি মাইথনের কাছে সবনপুরে প্রতিষ্ঠিত। এই মা ভূজ্যপত্রে (গাছের ছাল) বা খত (চিঠি)-তে অঙ্গীকার করেন, ” আমার প্রতিমূর্তি রাজরাজেশ্বরীর মন্দিরে যতদিন যাবৎ দুর্গাপুজো হবে আমি সেখানে মহাষ্টমীর দিন সন্ধিক্ষনে বিশেষরূপে অধিষ্ঠিত হব। এবং প্রমাণস্বরূপ দেবী দুর্গার যন্ত্রে সিঁদুরের ওপর পায়ের ছাপ ফেলে আসব। ” তাই মহাঅষ্টমীর সন্ধিক্ষণে এই শিখরভূমে মা দুর্গার পায়ের ছাপ দেখা যায়। কথিত আছে, ” মল্লে রা, শিখরে পা / সাক্ষাৎ দেখবি তো শান্তিপুরে যা…।”
পঞ্চকোটের ষোলো কল্পের পুজোয় আগমনী গানে গমগম করে রাজরাজেশ্বরীর ঠাকুরদালান। কোষাগারে যতই টান পড়ুক না কেন! কিংবা পঞ্চকোটের উচ্চাঙ্গ মার্গ সঙ্গীত ক্রমশ ক্ষয়িন্সু হয়ে এলেও সেই মূল ধারা থেকে এখনও সরে আসেনি। রাজদরবারের সঙ্গীত সৃজন আজও অটুট। পুজোর সময় দরবারি রাগের ঝাপতালে পাখোয়াজ, তবলা হারমোনিয়ামের বোলে যেন অতীতের সঙ্গীতকেই ফিরে ফিরে পাচ্ছে তামাম পঞ্চকোট।
প্রাচীন এই পুজোয় দরবারি গানে সঙ্গীতের মূর্ছনায় যেন আলোর বিচ্ছুরন ঘটতো! কেঁপে উঠত রাজপ্রাসাদের ঝাড়লন্ঠন! সুমধুর আগমনী সঙ্গীতে রাজদরবারেই রাজার উপস্থিতিতে গানে সুর দিতেন রাজেন্দ্রনারায়ণ সিং দেও-র মত সুরকাররা।
আসলে পঞ্চকোট রাজ পরিবারের সঙ্গীতের একটা আলাদা ঘরানা রয়েছে। এই রাজ দরবারে পা রেখেছিলেন যদুভট্টের মত সঙ্গীত বোদ্ধা। তাছাড়া ফি দুর্গা পুজোর আগমনী গানে সুর মেলাতে বেনারস থেকে আসতেন গহরজান, জানকীবাই, মালকার মত সঙ্গীতজ্ঞরা। ঝাড়খণ্ড থেকে আসতেন কমলা ঝরিয়াও। আজ সেই সঙ্গীতজ্ঞরা নেই। কিন্তু আগমনীর রেওয়াজ চলছেই। “আজকে পেলাম তোমায় উমা / মনের মাঝে রাখতে চাই / আঁধার ভবন করলে আলো/ এবার না মা বলবে যায়।” দুর্গাসঙ্গীতে আজও রাত জাগে পঞ্চকোট।