• আরজি কর কাণ্ড: দেহের কাছে ঘেঁষতে দেওয়া হয়নি ডোমকে! ময়নাতদন্ত ঘিরে নতুন প্রশ্ন তদন্তকারীদের
    আনন্দবাজার | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • আর জি কর হাসপাতালের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের ‘বিশ্বস্ত’ চিকিৎসকেরা যে চিকিৎসক-পড়ুয়ার ময়না তদন্তের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন, সিবিআই তদন্তে সে কথা সামনে এসেছে। এ বার ওই হাসপাতালের এক ডোমের বয়ানের ভিত্তিতে এই সংক্রান্ত আরও কিছু তথ্য সামনে এসেছে বলে দাবি সিবিআই তদন্তকারীদের।

    তদন্তকারীদের সূত্রের দাবি, ওই মর্গের কর্তব্যরত ডোমকে ময়না তদন্ত চলাকালীন মৃতদেহের আশেপাশে থাকতেই দেওয়া হয়নি। তাঁকে ঘরের কোণে একটি চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়েছিল। তদন্তকারীদের কথায়, ময়না তদন্তে মৃতের শরীরের সব ক্ষতস্থান খুঁজে বার করে, ময়না তদন্তকারী চিকিৎসককে ব্যবচ্ছেদে সাহায্য করেন ডোমরা। ব্যবচ্ছেদের পরে মৃতের শরীরে সেলাইও করেন তাঁরা। কিন্তু সে দিন ওই ডোমকে কোনও কাজই করতে দেওয়া হয়নি বলে তাঁর অভিযোগ। কোন কোন জায়গায় কী ধরনের ক্ষত, তা আড়াল করতে এমন করা হয়েছিল বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা। প্রধান ময়না তদন্তকারী চিকিৎসক অপূর্ব বিশ্বাস এবং ওই দিন কর্তব্যরত ডোমকে মুখোমুখি বসিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সেখানে এমন তথ্যই উঠে এসেছে বলে দাবি তদন্তকারীদের সূত্রে।

    ওই সূত্রের দাবি, ওই‌ দিন সূর্যাস্তের আগে যে সাতটি মৃতদেহের ময়না তদন্ত করা হয়েছিল, সেগুলিতে ডোমেরা উপস্থিত থেকে নিজেদের কাজ করেছিলেন। কিন্তু সূর্যাস্তের পরে চিকিৎসক-পড়ুয়ার ময়না তদন্তের ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি।

    তদন্তকারীদের কথায়, ময়না তদন্তে দেহের প্রত্যেকটি অংশের বিস্তারিত বিবরণ লেখা হয়। হাত, পা, মাথার চুল, আঙুলের নখ, চোখ, কান-সহ প্রত্যেকটি অংশের অবস্থার পৃথক ‘ফরম্যাট’ তৈরি করা হয়। ময়না তদন্তকারী চিকিৎসকেরা এক-একটি অঙ্গের নাম বলতে থাকেন। আর ডোমেরা ওই অঙ্গের ক্ষত ও আঘাতের চিহ্ন উল্লেখ করে ময়না তদন্তকারী চিকিৎসকে জানান। প্রত্যেক অঙ্গের খুঁটিনাটি এক-একটি ‘ফরম্যাট’-এ লেখা হয়। এর পর ওই ‘ফরম্যাট’ অনুযায়ী ডাক্তারেরা আঘাত ও ক্ষতচিহ্ন পর্যবেক্ষণ করেন, শরীরের নানা জায়গায় ব্যবচ্ছেদ করে মৃত্যুর সময় এবং কারণ নির্ধারণ করেন।

    তদন্তকারীদের সূত্রে দাবি, গত কয়েক দিনে ময়না তদন্তকারী চিকিৎসকদের আলাদা ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এর পর ওই হাসপাতালের মর্গের কয়েক জন ডোমকে আলাদা ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জানা যায়, ওই দিনের কর্তব্যরত ডোম ময়না তদন্তের সময়ে মৃতদেহের পাশে ছিলেন না। তদন্তকারীদের সূত্রে দাবি, অপূর্ব তাঁদের বলেছেন, ময়না তদন্তের পরে মর্গ থেকে মৃতদেহ হস্তান্তর করার জন্য ওই সময়ে কোনও কর্মী ছিলেন না। সেই কারণে কর্তব্যরত ডোমকে এক পাশে বসিয়ে রাখা হয়েছিল, যাতে তিনি সেই কাজের দায়িত্ব নিতে পারেন। এর পিছনে অন্য কোনও পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু ময়না তদন্ত চলাকালীন ডোমকে কোনও কাজ করতে দেওয়া হয়নি কেন? সূত্রের দাবি, সেই প্রশ্নের নির্দিষ্ট জবাব দিতে পারেননি অপূর্ব।

    তদন্তকারীদের কথায়, নিয়ম অনুযায়ী হাসপাতালের মর্গ ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। সে ক্ষেত্রে হাসপাতালে কোনও ওয়ার্ডে কারও মৃত্যু হওয়ার পর মৃতদেহ সরাসরি মর্গে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে দেহ আত্মীয়স্বজনদের দেওয়া হয়। আর অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির মৃতদেহ মর্গে সংরক্ষণের ব্যবস্থাও করা হয়।

    তদন্তকারীদের দাবি, ২৪ ঘণ্টায় তিন শিফটে ক্লার্ক এবং ডোম থাকা আবশ্যিক। কিন্তু ওই দিন কেন অন্যথা হল? তদন্তকারীদের সন্দেহ, মৃতদেহের ক্ষতচিহ্ন, আঘাতের খুঁটিনাটি, নমুনা সংগ্রহ এবং মৃত্যুর কারণ ও সময়ের বিষয়টি আড়ালে রাখার চেষ্টা হয়েছিল। সেই কারণে কর্তব্যরত ডোমকে সরিয়ে দেওয়া হয়ে থাকতে পারে। তদন্তকারীদের কথায়, ৯ অগস্ট সকাল সাড়ে ন’টায় মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। এর পর নমুনা সংগ্রহ, সুরতহাল রিপোর্ট এবং সব শেষে ময়না তদন্ত। প্রয়োজনীয় কর্মী না থাকলে আশপাশের সরকারি হাসপাতাল থেকে ডোম নিয়ে আসা যেতে পারত। কিন্তু তা করা হয়নি।

    সিবিআইয়ের এক কর্তার কথায়, “এত গুরুত্বপূর্ণ ময়না তদন্তের ক্ষেত্রে যতটা সম্ভব নিখুঁত পর্যবেক্ষণ এবং ব্যবচ্ছেদ করা হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে সবেতেই গাফিলতি হয়েছে।” এক তদন্তকারী অফিসার বলেন, “বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সুরতহালের সময়ে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটও ময়না তদন্তে উপস্থিত থাকেন। এ ক্ষেত্রে শোনা যাচ্ছে, তাঁকেও নাকি ময়না তদন্তের সময় থাকতে দেওয়া হয়নি। ওই বিষয়ে খোঁজ করা হচ্ছে। ওই জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে ফের তলব করা হবে।"

    সিবিআইয়ের এক কর্তার দাবি, "ঘটনার দিন সন্দীপের ঘনিষ্ঠ একাধিক আইনজীবী, পুলিশকর্তা ও চিকিৎসক হাসপাতালে ছিলেন। দ্বিতীয় বার যাতে ময়না তদন্ত করা না যায়, সে ব্যাপারে তাঁরা গোড়া থেকে সক্রিয় ছিলেন। তাঁরা জানতেন প্রথম রিপোর্টটি থেকে তদন্তে নানা সমস্যা হবে। সেই কারণে দ্রুত সৎকারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।"

    সিবিআইয়ের ওই কর্তার কথায়, ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় ময়না তদন্ত, সুরতহালের রিপোর্ট ছাড়া আর কোনও আদালত গ্রাহ্য জোরালো প্রমাণ হাতে থাকে না। তবে তথ্য প্রমাণ লোপাটের ধারায় জড়িতদের দোষী প্রমাণ করা যেতে পারে। শুক্রবারও আর জি কর হাসপাতালে গিয়ে কয়েক জন আধিকারিক এবং জুনিয়র চিকিৎসককে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তদন্তকারীরা।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)