• আগ্নেয়াস্ত্রর পাহারায় পুজো সোনার দুর্গার
    এই সময় | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • সঞ্চিতা মুখোপাধ্যায়, পুরুলিয়া

    দেবী কখনও আসেন নৌকায়, কখনও ঘোড়ায়। কিন্তু দেবী ব্যাঙ্কের লকার থেকে পুলিশি প্রোটেকশনেও আসেন, যে পুলিশের হাতে থাকে স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র।দেবী যদি মৃত্তিকা নির্মিত না হয়ে সোনার হন, তা হলে তো এমনই হওয়ার কথা। সেটাই হয় পুরুলিয়ার জয়পুর রাজবাড়ির পুজোয়। প্রায় সাড়ে ৯০০ গ্রামের সোনার মূর্তির পুজো হয় রাজবাড়িতে। শুধু সোনার মূল্যে নয়, ১৬৫ বছরের প্রাচীন এই মূর্তির অ্যান্টিক ভ্যালুও বিশাল। বছরের ৩৬১ দিনই দেবীর জায়গা হয় একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের লকারে। এর একটি চাবি থাকে ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের কাছে। আর একটি থাকে রাজ পরিবারে। পুজোর ৪ দিনের জন্য মন্দিরে সাধারণের সামনে নিয়ে আসা হয় সোনার এই মূর্তি।

    ব্যাঙ্ক থেকে পুলিশের গাড়িতে আসেন দেবী, ফিরেও যান একই ভাবে। কাতারে কাতারে মানুষ ভিড় জমান সোনার দুর্গা দেখার জন্য। পুলিশের কাছে নিরাপত্তা বজায় রাখাও বিরাট চ্যালেঞ্জ। গত বছর রাজ পরিবারের এক সদস্যের প্রয়াণে সোনার দুর্গাকে আনা হয়নি মন্দিরে। এ বার অবশ্য নিয়ম মেনে তিনি আসছেন। জেলার পুলিশ সুপার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘নিয়ম মেনে যাবতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে। মোতায়েন করা হবে সশস্ত্র রক্ষী।’

    জয়পুরের এই সোনার দুর্গাপুজোর ইতিহাস যে কোনও উপন্যাসের কাহিনির মতোই। রাজবংশের বর্তমান সদস্য প্রশান্ত নারায়ণ সিংদেও জানান, আনুমানিক ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁদের পূর্বপুরুষ জয়সিংহ তাঁর তিন ভাইকে নিয়ে উজ্জয়িনী থেকে ভাগ্যান্বেষণে আসেন জয়পুরে। সেই সময়ে ওই এলাকার ভূমিজ সর্দার ছিলেন খামার মুন্ডা। জয়সিংহের সঙ্গে তাঁর তুমুল লড়াই শুরু হয়।

    যুদ্ধে পরাজিত ভূমিজ সর্দারকে হত্যা করে এলাকার অধিকার নেন জয়সিংহ। নিজের নামে এলাকার নাম দেন জয়পুর। যুদ্ধের সময়ে খামার মুন্ডার হাতের খাঁড়া ছিনিয়ে নিয়েছিলেন জয়সিংহ। এই খাঁড়াটিকে শক্তিরূপে পুজো করতেন খামার মুন্ডা। জয়সিংহও একই ভাবে পুজো করতে থাকেন খাঁড়াটিকে। পরবর্তী কালে জয়সিংহের উত্তরপুরুষ সেই খাঁড়াটিকে পরিবারের ইষ্টদেবতা হিসেবে মেনে নিয়ে পুজোর সূচনা করেন। দেবী দুর্গার কলাবউয়ের সঙ্গে রেখে এই খাঁড়াটিরই পুজো হতো।

    ১৮৬৪ সালে জয়সিংহের সপ্তম পুরুষ মদনমোহন সিংহের পুত্র কাশীনাথ সিংহের আমলে খড়ের চালার মন্দির প্রদীপের আগুনে ভস্মীভূত হয়ে যায়। জনশ্রুতি, দেবী স্বপ্নে কাশীনাথকে বারাণসীর কনকদুর্গার আদলে বিগ্রহ গড়ে জয়পুরে প্রতিষ্ঠা করে পুজোর আদেশ দেন। এর পর বারাণসী থেকে কারিগর নিয়ে আসেন কাশীনাথ।

    মূর্তি তৈরির জন্য কারিগরদের এক সের ওজনের ১০৮টি সোনার আকবরি আসরফি দেন তিনি। এ ছাড়া প্রায় দু’মন ওজনের রূপো দিয়ে বিগ্রহের চালচিত্র তৈরির বরাত দেওয়া হয়েছিল। এক বছরের মধ্যেই তৈরি হয়ে যায় সেই মূর্তি। ১৮৬৫ সালে সেই বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে শুরু হয় পুজো।

    এর পর নির্মাণ করা হয় দেবীর জন্য পাকা মন্দির। কিন্তু, ১৯৭০ সালে একবার ডাকাতির ঘটনা ঘটে রাজবাড়িতে। দুষ্কৃতীরা যাবতীয় গয়না সমেত মূল্যবান সামগ্রী নিয়ে গেলেও তারা খোঁজ পায়নি লাল শালুতে মোড়া স্বর্ণমূর্তিটির। এই ঘটনার পরেই জেলা প্রশাসন ওই বিগ্রহ ব্যাঙ্কের লকারে রাখার পরামর্শ দেয়। তার পর থেকে একটি রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কের লকারে রাখা হয় সোনার মূর্তি। এ বারও সপ্তমী থেকে মূর্তি রাখা হবে মন্দিরে।
  • Link to this news (এই সময়)